বিছানায় শুলে হয়ত লাইট-টাইট কিছু চোখে পড়বে।
চলো, ক্যাপ্টেন বললেন, সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। এলিভেটর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েও থেমে গেল মুসা। একপাশে মাথা কাত করে কি যেন শুনল। কিশের শব্দ যেন শুনলাম।
কান পাতল সবাই। আর শোনা গেল না।
ডি ডেক সব চেয়ে নিচের ডেক, ক্যাপ্টেন বললেন। আলো খুব সামান্য। সাবধানে পা ফেলবে।
নিচে নেমেই চলেছে ওরা। শেষ হওয়ার আর নাম নেই। প্রতিটি ডেক পর পর সিঁড়ি আরও সরু হয়ে আসছে। অবশেষে ডি ডেকে নেমে মোড় নিল ওরা, টুরিস্ট ক্লাস কেবিন এরিয়ার দিকে। পানিরোধক একটা দরজা পেরিয়ে ঢুকল আরেক জায়গায়, ছোট ছোট কিছু কেবিন আছে ওখানে। এই সময় সামনে আবার শুনল শব্দ। চাপা, ভোতা, ঘষার আওয়াজ।
এইবার ঠিক শুনেছি! ঘোষণা করল মুসা। তবে এটা আগের শব্দটার মত নয়।
ইঁদুর-টিদুর হবে, চীফ বললেন। সব জাহাজেই থাকে।
সব জাহাজে থাকলেও আমাদের এটার কেবিনে নেই, ক্যাপ্টেন বললেন। তাছাড়া এত জোরে আওয়াজ করতে পারে না ইঁদুর।
সাবধানে, ম্লান আলোকিত বারান্দা ধরে সামনে এগোল ওরা। শব্দটা এখন আরও স্পষ্ট। কাছেরই একটা ছোট কেবিন থেকে আসছে। বাথরুমের ভেতর থেকে।
তোমরা সরে দাঁড়াও, ছেলেদের বলে গিয়ে দরজা খুললেন চীফ।
শুঁটকি! একসাথে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেরা।
হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে ময়দার বস্তার মত ফেলে রাখা হয়েছে টেরিয়ারকে। কথা বলার চেষ্টায় গোঁ গোঁ করে উঠল। চোখ প্রায় উল্টে যাওয়ার জোগাড়। দুজন পুলিশ গিয়ে তাকে বের করে বাঁধনমুক্ত করল।
দুর্বল ভঙ্গিতে প্রায় টলতে টলতে গিয়ে একটা বাংকে ধপ করে বসে পড়ল দুষ্ট ছেলেটা। কয়েক ঘন্টা ধরে আটকে আছি এখানে…সবে কেবিনটায় খুঁজতে শুরু করেছি, কে যেন পেছন থেকে এসে বাড়ি মারল মাথায়।
মিথ্যে কথা, প্রতিবাদ করল রবিন। এই তো ঘন্টাখানেক আগেই তোমাকে ওপরের ডেকে দেখেছি।
আমি নই। হয়ত আমার মত অন্য কাউকে দেখেছ, বলল টেরি। এমন ভাবে কেঁপে উঠল যেন খুব শীত করছে। হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় খুঁজে আমাকে বাথরুমে ভরে রাখল। আমি তো ভেবেছি জিন্দেগীতে আর বেরোতে পারব না! –
উচিত শিক্ষা হয়েছে তোমার, মুসা বলল। টকিগিরি করার শাস্তি।
একজন, নাকি দুজন এসেছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়ল টেরি। জানি না। দেখিইনি কাউকে। বাড়ি মেরে আরেকটু হ মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল, গোলআলুর মত ফুলে থাকা জায়গাটায় আঙুল ছোঁয়ালো সে।
হঠাৎ, জাহাজের সামনের দিকে কোথাও জোরে শব্দ হল, ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল বোধহয় আয়না বা কাচের কিছু।
ভুরু কুঁচকে ফেললেন ক্যাপ্টেন। বাইশ নাম্বারের কাছে মনে হল!
জলদি চলুন, চিষ্কার করে বলল কিশোর।
টেরি নড়ল না। আমি আর যাচ্ছি না বাবা, বড় বাঁচা বেঁচেছি। গুপ্তধনের দরকার নেই আমার। তোমরা গিয়ে নাওগে।
টেরির কাছে একজন লোক রেখে অন্যদেরকে নিয়ে দৌড় দিলেন চীফ। সরু বারান্দা ধরে ছুটল সবাই ক্যাপ্টেনের পিছু পিছু। শেষ একটা মোড় ঘুরে ক্যাপ্টেন দেখালেন, ওই যে সামনে, বাইশ।
খাইছে! দেখ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
বাইশ নাম্বার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে জেনি এজটার, পেছনে তার মোটা ভাই মাইক। দলটাকে দেখে ঘুরে উল্টোদিকে দিল দৌড়। মাইকের হাতে হোট কালো একটা বাক্স, আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
দাঁড়াও! বললেন চীফ। পুলিশ!
থামল তো না-ই, ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল ভাইবোন। আগে আগে রয়েছে রোগাটে বোন, পেছনে ছুটন্ত ভাইয়ের শরীরের মাংস হাস্যকর ভঙ্গিতে দুলছে। নাচতে নাচতে চলেছে যেন একটা জেলির পিণ্ড! দুপদাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। পেছনে তেড়ে গেল গোয়েন্দারা। বি-ডেকে টুরিস্ট লাউঞ্জের একটা। দরজা দিয়ে ঢুকে গেল দুজনে।
বেরোনোর পথ বাঁ-দিকে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ক্যাপ্টেন। ওদেরকে সামনে থেকে ধরব!
করিডর ধরে তাঁর সঙ্গে ছুটল মুসা। অন্যেরা দাঁড়িয়ে গেল আরেকটা দরজা আটকে, যাতে এদিক দিয়ে আবার বেরিয়ে আসতে না পারে ভাইবোন। মুসা আর ক্যাপ্টেনকে দেখতে পেল দুজনে। চোখের পলকে পথ বদল করল জেনি, দৌড় দিল রাইটিং রুমের দরজার দিকে। হাঁপিয়ে পড়েছে মোটা মাইক। বোনকে অনুসরণ করে তীক্ষ্ণ মোড় নিতে গিয়ে পা পিছলাল। প্রায় জাহাজ কাঁপিয়ে ধুড়ুম করে পড়ল আছাড় খেয়ে। শোল মাছের মত পিছলে গিয়ে বাড়ি খেল তিনটে টেবিল আর দেয়ালের সঙ্গে। হাত থেকে উড়ে চলে গেল কালো বাক্সটা। উঠে যে তুলবে সেশক্তি নেই। জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে।
ভাইয়ের দুরবস্থা দেখে থেমে গেল জেনি। গাল দিয়ে উঠল, মোটকা গাধা কোথাকার!
ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মাইক। তাকে উঠতে সাহায্য করলেন চীফ। জেনিকে ধরে রাখল একজন পুলিশ। কালো বাক্সটা তুলে নিল কিশোর।
নিশ্চয় আড়িপেতে আমাদের কথা শুনেছে ওরা। তখনই কোনভাবে শব্দ করে –
ফেলেছিল, মুসা শুনেছে, বলল সে। কেবিনের নাম্বার শুনেই আর দেরি করেনি, ছুটে চলে গেছে। বাক্সটা কোথায় পাওয়া গেছে, মিস এজটার? বাইশ নাম্বার কেবিনে নিশ্চয়?
কালো হয়ে গেছে জেনির মুখ। মাথা ঝাঁকাল। সিলিঙে।
খোল বাক্সটা, কিশোর, তর সইছে না রবিনের।
বাক্সটা খুলল কিশোর। সবাই তাকিয়ে রইল চকচকে পাথরগুলোর দিকে। তারপর সামনে ঝুঁকলেন চীফ। সবুজ একটা পাথর তুলে হাতে নিয়ে দেখলেন। এটা রত্ন নয়, কাচ! একটার সঙ্গে আরেকটা ঘষা দিয়ে দেখে বললেন, সব কাচ এগুলো।