পরের হপ্তা! মাথা নাড়ল রবিন হতাশ ভঙ্গিতে। রোজ দেখানোর বন্দোবস্ত করে না কেন?
দর্শক হয় না হয়ত, আন্দাজ করল কিশোর।
হঠাৎ হাত তুলে দেখাল মুসা, এই দেখ, জাহাজের ওপর!
একেবারে ওপরের ডেকে দেখা যাচ্ছে একটা লম্বা মূর্তি। ঝিক করে উঠল দাঁত। নাকটা যেন সরাসরি ওদেরই দিকে ঠেলে দিল দূরের মূর্তিটা।…
শুঁটকি, গুঙিয়ে উঠল মুসা।
দ্রুত চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। ঘাটের ডানে চওড়া একটা গেট খোলা এখনও, মাল আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার হয় ওটা। চট করে একবার অ্যাটেনডেন্টের দিকে তাকাল সে, টুরিস্টদের শেষ দলটাকে প্রায় খেদিয়ে নিয়ে চলেছে গেটের দিকে।
এই, কুইক, সঙ্গীদের বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
চওড়া গেটটা দিয়ে ঢুকে পড়ল ওরা, দৌড় দিল গ্যাংপ্লাঙ্কের দিকে। সবার আগে রয়েছে মুসা। ধাক্কা খেল গ্যাংব্ল্যাঙ্ক দিয়ে নেমে আসা লম্বা একজন মানুষের সঙ্গে। আউফ করে উঠল। পড়েই যাচ্ছিল, ধরে ফেললেন তাকে জাহাজের ক্যাপ্টেনের পোশাক পরা লোকটা।
কি ব্যাপার, থোকা? ভারি কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। তাড়াহুড়ো করে লাভ হবে না। প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেছে।
জানি, স্যার, এগিয়ে গেল কিশোর, কিন্তু আমরা…
জানো? তাহলে চলে যাবার অনুরোধ করব আমি তোমাদেরকে।
পেছনে তাকিয়ে কিশোর দেখল, কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকজন অ্যাটেনডেন্ট, সে তাকাতেই বেরিয়ে যাবার ইশারা করল একজন।
ক্যাপ্টেন, মরিয়া হয়ে বলল কিশোর, আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
দেখ, হাসলেন লম্বা মানুষটা, আমি আসল ক্যাপ্টেন নই। একজিবিশন ম্যানেজার। তবে ক্যাপ্টেন ডাকতে পার, আপত্তি নেই। জাহাজ দেখতে আসা যে কারও সাথে আলাপ করতে দ্বিধা নেই আমার, কিন্তু এখন…
আমরা দর্শক নই, চেঁচিয়ে উঠল নরি। আমরা স্যার গোয়েন্দা। এখন একটা কেসে কাজ করছি। কিশোর, কার্ড দেখিয়ে দাও।
কার্ড বের করে দেখাল কিশোর। আমরা জেনেছি আপনার জাহাজে কিছু জিনিস লুকানো আছে।
কার্ডটা পড়ে মুখ তুললেন ক্যাপ্টেন। লুকানো? অনেক টাকার মূল্যবান পাথর, স্যার, মুসা বলল। রত্ন।
রত্ন, না? এটাই তাহলে ব্যাখ্যা!
অধৈর্য হয়ে এগিয়ে এল কয়েকজন অ্যাটেনডেন্ট। হাত নেড়ে তাদেরকে সরে যাবার ইঙ্গিত করলেন ক্যাপ্টেন। ছেলেদের দিকে ফিরলেন আবার। জাহাজের কেবিনের অনেকগুলো বেড় আজ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা ভেবেছি মজা করার জন্যে করেছে কেউ।
মা, স্যার, কিশোর বলল, মজা করার জন্যে নয়। রত খুঁজেছে। বিছানার ভেতর কিংবা আশেপাশে লুকানো রয়েছে পাথরগুলো। সংক্ষেপে জানাল ডেন কারমলের আজব উইলের কথা। ধাঁধাগুলোর সমাধান আমরা করে ফেলেছি। এখন সঠিক বিছানাটা শুধু পেলেই হল। দেরি হয়ে না গিয়ে থাকলেই হয়।
বোধহয় হয়ে গেছে। অনেকগুলো বিছানা সরানো হয়েছে। কিন্তু যদি পাথরগুলো এখনও পেয়ে না গিয়ে থাকে, তুমি কি করে পাবে? ঠিক বিছানাটা বের করবে কিভাবে? পাঁচশো বিছানা আছে জাহাজে।
ঢোঁক গিলল কিশোর। দমে গেল অন্যেরা।
পাঁ-পাঁচশো? তোতলাল রবিন।
কোন কোন কেবিনে দুতিনটে করেও আছে। মোট পাচশো।
বিশেষ কোন বিছানা আছে? মুসা জিজ্ঞেস করল। কোন রানী-টানীর জন্যে। সংরক্ষিত?
না, ওরকম কিছু নেই। কুইন-সাইজ বেড যেগুলোকে বলে সেরকম কিছু? রবিন প্রশ্ন করল।
না। ওরকম বিছানা জনপ্রিয় হওয়ার আগেই জাহাজটার সাগরে চলার দিন ফুরিয়ে গেছে।
আস্তে মাথা দোলাল কিশোর। বিছানাটা পাবার নিশ্চয় কোন উপায় আছে। ক্যাপ্টেন, জাহাজটা কি অস্ট্রেলিয়ায় গেছে কখনও?
বহুবার। লণ্ডন-অস্ট্রেলিয়া-ক্যানাডা রুটে যাতায়াত করত নিয়মিত। কারমল ওতে করেই অস্ট্রেলিয়া গিয়ে! ভাবছ নাকি?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, ওল্ড নেড বোধহয় কেউ একজন একলা ব্যবহার করত। পুরানো প্যাসেঞ্জারদের লিস্ট আছে।
আছে, তবে লণ্ডনে। এই ধাঁধা তোমাদেরকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে তো?
করতেও পারে, গোঁ গোঁ করে বলল মুসা। কারমলের কথা কিছু বলা যায় না।
পাওয়ার উপায় একটা নিশ্চয় আছে, কিশোর বলল। ইস, হাতে যদি খালি সময় থাকত! তবে আমার বিশ্বাস এখনও খুঁজে পায়নি কেউ। তাহলে শুঁটকি জাহাজে থাকত না। তবে সে বা অন্য কেউ পেয়ে যেতে পারে যে-কোন মুহূর্তে।
শুঁটকি? ভুরু কোঁচকালেন ক্যাপ্টেন। তারমানে জাহাজে রয়েছে এখনও একজন? বেশ, দেখছি।
গ্যাংওয়ে ধরে এগোলেন ক্যাপ্টেন। ছেলেরা চলল তার সঙ্গে সঙ্গে। কিশোর কি যেন ভাবছে। হঠাৎ বলে উঠল, মনে হয় বুঝতে পেরেছি…, কথা শেষ হল না তার। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে একটা লাইফবোটের দিকে। সাবধান!
অনেক ওপরে জাহাজের একটা লাইফবোট খসে গেছে ওটার ব্র্যাকেট থেকে, দোল খেয়ে নেমে এসে বাড়ি মারল জাহাজের গায়ে, হুড়মুড় করে ঝরে পড়ল কতগুলো দাড়, পিপে, বাক্স আর আরও কিছু ভারি মালপত্র। ছুটে এল ক্যাপ্টেন আর ছেলেদেরকে লক্ষ্য করে।
সর! বলেই ধাক্কা দিয়ে মুসাকে সরিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। খপ করে নরির হাত চেপে ধরে তাকে টেনে নিয়ে সরে গেলেন একপাশে।
গ্যাংওয়ের নিচে ডাইভ দিয়ে পড়ল রবিন। কিশোরও অনেক দূরে সরে গেছে। নরিকে ফেলে দিয়ে তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে তাকে গা দিয়ে আড়াল করলেন ক্যাপ্টেন।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কেউ নড়ল না। তারপর, আবার একে একে উঠে দাঁড়াতে লাগল সবাই। অ্যাটেনডেন্টরা দৌড়ে এল। দোল খাচ্ছে এখনও লাইফবোটটা, সেদিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের চেহারা। অ্যাটেডেন্টদের আদেশ দিলেন, জলদি গিয়ে জায়গামত আটকাও ওটাকে। ছেলেদের দিকে ফিরে বললেন, সরে থাকবে। ব্যাপারটা দুর্ঘটনা না-ও হতে পারে। হবার কথা নয়। খুব ভাল মত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় ওটা, নিয়মিত চেক করা হয়।