রাফিয়ানের কোনদিকে কান নেই। চেঁচিয়ে ডাকছে জিনা, শুনতেই পেল না। চোখের পলকে পৌঁছে গেল বেড়ালের ঝুড়ির কাছে।
ঘাউ! ঘাউ! প্রচণ্ড চিৎকার করছে নাক দিয়ে ঠেলে খোলার চেষ্টা করছে বেড়ালের বুড়ির মুখ।
মিয়াঁওও! ভেতর থেকে এল রাগতঃ প্রতিবাদ। ছিটিক হিটিক করে জোরে জোরে থুথু ছেটানোর শব্দ, তারপর তীক্ষ্ণ হিসহিস। ঝট করে বেরিয়ে এল একটা রোমশ কালো থাবা, বেরিয়ে পড়েছে ধারালো নখগুলো। আঘাত হানল রাফিয়ানের নাকে।
আঁউও! করে আর্তনাদ করে উঠল রাফিয়ান। পিছিয়ে এল। বদমেজাজী কুকুর নয় সে, বেড়াল তাড়া করে স্বভাবের কারণে, মজা করার জন্যে, মারার জন্যে নয়। কিন্তু খুড়ির ভেতরে বোকা গাধাটা তার মতলব বুঝতে পারেনি, ভয়ঙ্কর হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে। আরে বাবা, অন্য সময় যেমন গাছে উঠে পালিয়ে যাস, তেমনি পালিয়ে গেলেই পারতিস! যত্তোসব!
হতভম্ব হয়ে গেল রাফিয়ান। তার পিঠের ওপরে ঝুড়ির দুটো হ্যাণ্ডেল বাড়ি খাচ্ছে। নাক থেকে গড়িয়ে পড়ল দুই ফোঁটা রক্ত।
দারুণ দেখিয়েছিস, ম্যাগি! বলল বেড়ালের মনিব। খুব ভাল করেছিস। আচ্ছা শিক্ষা হয়েছে বেয়াদব কুকুরটার।
জবাবে আরেকবার হিসিয়ে উঠল ম্যাগি। যেন কুকুরটাকে ডেকে বলল, আর লাগতে আসবি আমার সাথে, কুকুর কোথাকার!
হতবাক হয়ে পড়েছে জিনাও। রাফিয়ানেরই দোষ। তাই মহিলাকে কিছু বলল না, শুধু চোখের আগুনে একবার ভ করার চেষ্টা চালাল। রাফিয়ানের কলার চেপে ধরল একহাতে, আরেকহাতে ঝুড়ির আঙটা আরেকটা আঙটা ধরতে বলল মুসাকে। বয়ে নিয়ে এল কুকুরটাকে। যার যার সিটে এসে বসল। কামরায় প্রচণ্ড হাসাহাসি চলছে। কুকুরটাকে বসতে বলার কথা পর্যন্ত ভুলে গেছে জিনা। ঝুড়ি পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়েই আছে রাফিয়ান। বিচিত্র দৃশ্য। তাতে হাসি আরও বাড়ছে লোকের।
ছেলেমেয়েরা হাসল না। এত গোলমাল কিসের, বুঝতে পারল না রাফিয়ান।
অবশেষে যাত্রা শেষ হল।
খোলা বাতাসে বেরিয়ে এল আবার ওরা। রাফিয়ানকে ঝুড়ি থেকে বের করে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল।
নিশ্চয় সামনের ওই চওড়া রাস্তাটাই অ্যালমণ্ড রোড, রবিন বলল।
২৮ নাম্বার খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। অনেক পুরানো একটা বাড়ি। তবে বেশ সুরক্ষিত, নতুন রঙ করা হয়েছে। ধনী একজন ইংরেজ ভদ্রমহিলা এরকম জায়গায়ই বাস করবেন আশা করেছিল ছেলেমেয়েরা।
ঘন্টা বাজাল কিশোর। দরজা খুলে দিল এক মহিলা, বাড়ির কেয়ারটেকার, ওদের সঙ্গে হাসি মুখেই কথা বলল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মহিলা বলল, অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন মিস মেয়ারবাল। একাই থাকতেন। বিশেষ কেউ আসতও না তার কাছে, শুধু একজন ছাড়া। তার মতই বৃদ্ধা, মিসেস ডিকেনস। হ্যাঁ, মিস মেয়ারবালকে যেদিন কবর দেয়া হল সেদিনও এসেছিলেন মহিলা, শেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে…
একনাগাড়ে বলে চলেছে মহিলা, কথা যেন আর ফুরায়ই না। খানিকক্ষণ উসখুস করে শেষে তাকে থামানোর জন্যে কিশোর বলল, মিসেস ডিকেনস-এর প্রথম নামটা জানেন? মনিকা, তাই না?
মনিকা? হ্যাঁ, বোধহয়। হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার শুনেছি বলেও মনে পড়ছে…
কোথায় থাকে জানেন? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মুসা।
নিশ্চয় জান। একদিন মিসেস মেয়ারবাল আমাকে বললেন, একটা জিনিস নিয়ে গিয়ে মিসেস ডিকেনসকে দিয়ে আসতে…
ঠিকানাটা বলুন, জলদি! আর ধৈর্য রাখতে পারছে না জিনা। চেঁচিয়ে উঠল।
তার কথায় থমকে গেল মহিলা। ভুরু কুঁচকে তাকাল। এখুনি যেন নিজেকে গুটিয়ে নেবে শামুকের মত। তাড়াতাড়ি সামাল দেয়ার জন্যে হাসল রবিন। ব্যাপারটা খুব জরুরি, ম্যাম, প্লীজ! মিসেস ডিকেনসকে আমাদের খুব দরকার। একমাত্র আপনিই জানাতে পারবেন তাঁর ঠিকানা।
আবার হাসি ফুটল কেয়ারটেকারের মুখে। তবে জিনার দিকে আর ফিরেও তাকাল না। বলল, দরকার, না? বেশ। লিখে নেবে নাকি? হিরনু স্ট্রীটে থাকেন তিনি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।
হেঁটেই যাবার সিদ্ধান্ত নিল ওরা।
ঠিকানামত আরেকটা মস্ত বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। ওটারই একটা ফ্ল্যাটে থাকেন মিসেস ডিকেনস। কিশোর বেল বাজালে দরজা খুলে দিল এক তরুণী, কোলে বাচ্চা। হেসে বলল, হাল্লো, কি করতে পারি?
কেন এসেছে জানাল কিশোর। বিষণ্ণ হয়ে গেল মেয়েটা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেরি করে ফেলেছ। গত হপ্তায় মারা গেছেন তিনি। মিস মেয়ারবালের শেষ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, বেশি রাত করে ফেলেছিলেন। ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়ায় ধরল। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই শেষ।
নীররে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল ছেলেমেয়েরা। তদন্ত এখানেই শেষ। যার নামে নেকলেসটা উইল করে দিয়ে গেছেন মিস মেয়ারবাল, তিনিও আর বেঁচে নেই।
দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, মিসেস ডিকেনসের কোন আত্মীয় স্বজন আছে, জানেন? স্বামী, কিংবা ছেলেমেয়ে?
স্বামী মারা গেছেন অনেকদিন আগেই। তবে শুনেছি, এক মেয়ে আছে।
কোথায় থাকে বলতে পারবেন?
না। এখানে মাত্র দুমাস হল এসেছি। তবে আরও ফ্ল্যাট আছে, পুরানো লোকও আছে, তারা হয়ত কিছু বলতে পারবে। একজন থাকেন মিসেস ডিকেনসের পাশের ফ্ল্যাটে, বৃদ্ধা। তিনি জানতে পারেন।
ভাবল কিশোর। সবার দরজায় টোকা দিয়ে লাভ নেই। বরং ওই বৃদ্ধাকেই জিজ্ঞেস করা যাক।
ঠিক জায়গাতেই এল সে। প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা বললেন, হ্যাঁ, জানি। মনিকার মেয়ের নাম মিলি। অনেক আগে বিয়ে হয়েছে। দাওয়াতে আমিও গিয়েছিলাম।