প্রথমেই, কিশোর বলল, মনিকা ডিকেনসের নাম খুঁজতে হবে টেলিফোন বুকে।
ঠিক, বলতে বলতে মোটা ডিরেকটরিটা টেনে নিল রবিন। দেখি।
দ্রুত পাতা উল্টে চলল সে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে বুকে এল অন্য তিনজন। ডিকেনস কয়েকটাই পেল, কিন্তু মনিকা ডিকেনস একজনও নেই।
আরেকবার দেখা যাক, মুসা পরামর্শ দিল।
দরকার নেই, কিশোর বলল। এতগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিশ্চয় লুকিয়ে থাকেনি নামটা।
হয়ত মহিলার টেলিফোন নেই, রবিন বলল।
হতে পারে, জিনা বলল।
কিংবা এ-শহর থেকে চলে গেছে,বলল মুসা।
বিয়েও হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, অনুমান করল রবিন। স্বামীর নাম হয়ত ডিকেনস নয়।
অথবা মিস মেয়ারবালের মত মরেও গিয়ে থাকতে পারে, ঘোষণা করল যেন কিশোর।
তাই তো, এটা তো ভেবে দেখিনি, জিনা বলল। বিশ বছর আগে উইলটা করা হয়েছে। আর এত ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যখন, মিস মেয়ারবালের সমবয়সীও হতে পারে। তাহলে মরে যাবারই কথা।
কিন্তু সেটা জানব কিভাবে আমরা? মুসার জিজ্ঞাসা।
হুফ! রাফিয়ানও যেন একই প্রশ্ন করল।
গম্ভীর হয়ে গেল সবাই। কিশোর বাদে। কাজ জটিল হলেই তার আনন্দ। হাসিমুখে বলল, সহজেই সেরে ফেলব ভেবেছিলাম আমরা, শুধু টেলিফোন বুক দেখেই। হল না।
ইস, ঠিকানাটাও যদি লিখে রেখে যেতেন মিস মেয়ারবাল! জিনা আফসোস করল।।
নিজের কপালে টোকা দিল কিশোর। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। মিস মেয়ারবালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক। খুঁজলে কিছু বেরিয়েও পড়তে পারে। তার ঠিকানা আছে দলিলে।
ঠিক বলেছ! তুড়ি বাজালমুসা। কিন্তু গিয়ে কি খুঁজব ওখানে?
মিস মেয়ারবালের পড়শী থাকতে পারে। তাকে বা তাদেরকে জিজ্ঞেস করব। ওরা হত এমন কোন সূত্র জানাতে পারে, যাতে মনিকা ডিকেনসকে খুঁজতে সুবিধে হয়।
হ্যাঁ, ভাল বলেছ, একমত হল রবিন। তা-ই করা উচিত।
জিনা খুশি হতে পারছে না। মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোরের কথায় সায় জানাল, হ্যাঁ, বুদ্ধিটা ভাল। কিন্তু যাব কিভাবে?
কেন, বাসে, রবিন বলল। ট্রেনেও যেতে পারি। লণ্ডনের মত এই শহরেও পাতালরেল রয়েছে। ট্রেনে করে যেতে অসুবিধে কি?
আমাদের অসুবিধে নেই, জিনা বলল। কিন্তু রাফি যাবে কিভাবে? বাক্সে ভরে নেব নাকি? ওকে বাড়িতে রেখে যেতে পারব না।
তাই তো, চোয়াল স্কুলে পড়ল রবিনের। ঋড়িতে করে ছাড়া পাতালরেলে কোন জানোয়ার নেবার অনুমতি নেই। না হয় ভরলাম। কিন্তু যা ভারি ও। কতক্ষণ বয়ে নিতে পারব? কি করা যায় বলতো?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব মিলল না। ভাবছে সবাই। বার দুই নীরবে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। উজ্জ্বল হল মুখ। ঝুড়িতে করেই যাবে। কিন্তু আমাদের বয়ে নিতে হবে না ওকে। ওর বোঝা ও-ই বইবে।
ধাঁধা বললে নাকি? মুসা ভুরু নাচাল।
মোটেও না,মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ওঠো। রওনা হই।
কিশোরের পিছে পিছে চলল সবাই। অবাক হয়ে ভাবছে, কি করবে গোয়েন্দাপ্রধান?
রান্নাঘরে ঢুকল কিশোর। বেতের বড় একটা বাজার করার ঝুড়ি বের করল। চলো, বাই, বলল সে।
কাছের টিউব-রেল স্টেশনটায় চলে এল ওরা। শহরের একটা ম্যাপ জোগাড় করে নিতে কষ্ট হল না। অ্যালমণ্ড রোডটা কোথায় খোঁজ করল তাতে। …
ছুরি বের করে ঝুড়ির নিচের দিকে চারটে গোল ফোকর কাটল কিশোর। তারপর ঝুড়ির মুখ খুলে ইশারা করল রাফিয়ানকে। একান্ত বাধ্য ছেলের মত ঋড়িতে ঢুকে পড়ল বুদ্ধিমান রাফিয়ান। বুড়ির আঙটা ধরল কিশোর, আরেকটা মুসা। দুজনে মিলে কুকুরটাকে বয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল প্ল্যাটফর্মে।
টিকেট ক্লার্কের চোখে পড়বে না এমন একটা জায়গায় এসে নামিয়ে রাখল ঝুড়িটা। কিশোর আদেশ দিল, এবার হাঁট রাফি। দেখ চেষ্টা করে পারিস কিনা।
চার ফোকরে চার পা ঢুকিয়ে ঝুড়ি নিয়ে উঠে দাঁড়াল রাফিয়ান। হাঁটতে শুরু করল। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে হো হো করে হেসে উঠল মুসা। তার হাসিতে যোগ দিল রবিন আর জিনা।
এই, অত হেসো না, হুঁশিয়ার করল কিশোর। স্টেশনের কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হবে।
কুকুরের পা নিয়ে হাঁটছে একটা বুড়ি। ওই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরা। মুচকি হাসল কেউ কেউ।
প্ল্যাটফর্মের একধারে এসে রাফিয়ানকে বলল কিশোর, বসে থাক!
বাধ্য ছেলের মত ঝুড়ি নিয়ে বসে পড়ল কুকুরটা।
রবিন গিয়ে টিকেট কেটে আনল। এরপর ট্রেনের অপেক্ষা।
ট্রেন এল। ধরাধরি করে ঝুড়িটা তোলা হল। মুখোমুখি দুটো সিটে বসল ছেলেময়েরা, একেক সিটে দুজন করে।
খুব লক্ষ্মী ছেলে, রাফিয়ানের প্রশংসা করল জিনা। ওর মত কুকুরই হয় না। কেমন চুপচাপ রয়েছে। অবশ্যই লক্ষ্মী রাফিয়ান, অনেক কুকুরের চেয়ে বুদ্ধিও ধরে বেশি। তবে জাতে সে কুকুর। আর কুকুরের যা স্বভাব, বেড়াল দেখতে পারে না।
জিনা যখন তার প্রশংসা করছে, ঠিক ওই সময় বাতাসে না-পছন্দের জিনিসের গন্ধ পেয়েছে রাফিয়ান। ওই কামরারই একধারে এক মহিলা বসেছে, পায়ের কাছে একটা বেতের ঝুড়ি, মুখ বন্ধ। নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে ওটার ভেতর। বেড়াল!
ঘাউ করে উঠল রাফিয়ান। বিকট চিৎকার। ঝুড়িতে ওকে চুপচাপ থাকতে হবে একথা আর মনে রইল না। লাফ দিয়ে উঠে বুড়ি নিয়েই ছুটল।
তুমুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল কামরার ভেতরে। যাত্রীরা অবাক। বুড়ি হাঁটে কি করে! তারপর ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিশাল এক কুকুরের মুখ। ভয়ে কুঁকড়ে গেল কেউ। তবে বেশির ভাগই উপভোগ করল ব্যাপারটা। হাসিতে ফেটে পড়ল ওরা।