তুমি বুঝে ফেলেছ! সারপ্রাইজ দিতে না পেরে হতাশ হল জিনা।
রবিন আর মুসা অবাক হল। রবিন বলল, কই, আমাদেরকে তো কিছু। বলনি?
হাসল শুধু কিশোর। জবাব দিল না।
রাফি যাচ্ছে তো? মুসা জানতে চাইল।
নিশ্চয়ই, বলল জিনা। বাৰা ভাল করেই জানে, আমি ওকে ছাড়া কোথাও যাই না। চল, বাগানে, ঘরে দম আটকে আসছে। কপাল ভাল আমাদের, আজ বৃষ্টি নেই।
বলা যায় না, রবিন বলল। আবার এসে যেতে পারে।
তা ওখানে গিয়ে কোথায় উঠছি, জিনা…থুড়ি জর্জ? কিশোর জানতে চাইল। হোটেলে?
দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জিনা। তারপর হাসল। থাক, জর্জ বলার দরকার নেই, তোমরা আমাকে জিনাই ডেকো।…না, হোটেলে উঠছি না আমরা। এখন ছুটির সময়, খরচ অতিরিক্ত ঘর পাওয়াও কঠিন। তাছাড়া হোটেলে কুকুর জায়গা দেয়ার নিয়মও বোধহয় নেই। সম্মেলন যেখানে হচ্ছে, সেই শহরে মার এক বোনের বাসা আছে। খালাম্মা-খালু ছুটিতে বাইরে চলে যাচ্ছেন, ফ্ল্যাটটা খালিই থাকবে। মাকে বলেছেন, ওখানে থাকতে পারব আমরা।
চমৎকার। হোটেলের চেয়ে অনেক ভাল হবে। স্বাধীনতা থাকবে।
সাগরের পাড়ে হাঁটতে বেরোল ওরা। চলল নানারকম আলোচনা। ছুটি কি করে কাটাবে সে-সম্পর্কে আলোচনাই বেশি হল। ফিরল দুপুরের খাবার সময়। মুরগীর রোস্ট করেছে আইলিন। আপেলের জেলি। মাংসের কিমা আর নানারকম শাকসবজীর পুর দেয়া স্যাণ্ডউইচ। সাগরের খোলা হাওয়া আর বৃষ্টিধোঁয়া রোদে ঘুরে খিদেও পেয়েছে ছেলেময়েদের। খাবারের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা। মিনিট পনেরো মুসা তো মুখই তুলল না।
দুপুরের পরে আবার খারাপ হয়ে গেল আকাশ। মেঘে ঢাকা পড়ল সূর্য। নামল ঝমঝম বৃষ্টি। বাইরে বেরোনো বন্ধ। তবে আজ আর জিনার খারাপ লাগল না। তিন তিনজন বন্ধু এসেছে, ঘরের ভেতরেই সময় খুব ভাল কাটবে।
পরদিন সকালে রওনা হল ওরা। বাস ধরে এল এয়ারপোটে। সেখান থেকে বিমানে লওন। তারপর ঘন্টা দুয়েকের রেলযাত্রা। স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে করে এল জিনার খালার ফ্ল্যাটে।
বেশ ব্যস্ত একটা সড়কের দিকে মুখ করে রয়েছে বাড়িটা। বড় ফ্ল্যাট। কয়েকটা ঘর। মাঝে চওড়া বারান্দা। বেডরুমগুলো সব পুবমুখো, অন্যান্য বরগুলো পশ্চিমে।
বাড়িটা পছন্দ হল ছেলেমেয়েদের। ঘরের আসবাবপত্রও ভাল। আয়-রোজগার বেশ ভালই মনে হয় জিনার খালু-খালাম্মার। অন্যের ঘরে রয়েছে, এটুকু বোঝার বুদ্ধি আছে রাফিয়ানের, কাজেই জিনিসপত্র যাতে নষ্ট নাহয় সেভাবে চলাফেরা করল। বাড়িতে হলে এতক্ষণে লাফালফি করতে গিয়ে অন্তত একটা ফুলদানী তো উল্টে ফেলতোই।
নিজেদের জিনিসপত্র খুলে গুছিয়ে ফেলল ছেলেমেয়েরা। তারপর গেল মিসেস পারকার কতখানি কি করেছেন দেখার জন্যে।
তিনিও গুছিয়ে ফেলেছেন। বললেন, এখন আমাদের প্রথম কাজ হল, খাবার কিনে আনা। একসাথে দুকাজ হয়ে যাবে। খাবারও কেনা হবে, শহরও ঘোরা
হবে। তোমাদের আঙ্কেল কাজ নিয়েই ব্যস্ত, তিনি যেতে পারবেন না। যেতে হবে, আমাদেরকেই।
তাতে খুশিই হল ছেলেমেয়েরা।
শহরটা আমেরিকার শহরের চেয়ে অন্যরকম, কিশোর বলল। বাস, লোকের ভিড়। বেশি গাদাগাদি মনে হয়।
সকলেই একমত হল তার সাথে।
দোকানে দোকনে ঘুরল ওরা। চলে এল কাছের বড় স্কোয়্যারটায়। বিশাল এক বাগান রয়েছে সেখানে, অনেকটা পার্কের মত, ছেলেমেয়েরা খেলছে। দিকে দিকে ছুটে যাচ্ছে বাস। এত বিভিন্ন পথে, মনে রাখতেই কষ্ট হয়, শেষ নোটবুকে লিখে নিতে লাগল রুটগুলো রবিন। খাবারের বাক্স, পোটলা নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে এল ওরা। রান্নাঘরে জিনার মাকে সাহায্য করল সবাই, মিস্টার পারকার বাদে, তিনি তার কাজে ব্যস্ত। আধুনিক, সুন্দর রান্নাঘর। প্রয়োজনীয় সব জিনিস হাতের কাছে রয়েছে। কাজ করতে কোন অসুবিধে হল না।
রাতের বেলা খাবার টেবিলে সকলের সঙ্গে কথা বলার ফুরসত মিলল মিস্টার পারকারের। জানালেন, সম্মেলন যতদিন চলবে, রোজ খুব সকালে বেরিয়ে যাবেন – তিনি, ফিরতে অনেক দেরি হবে। রাতও হয়ে যেতে পারে কোন কোনদিন।
সেটা আমি জানি, মিসেস পারকার বললেন। তোমার কাজ তুমি করে যাও, আমাদের জন্যে ভাবতে হবে না। আমাদের দিক আমরা সামলাতে পারব। রান্না করতে তো আর বেশি সময় লাগবে না। তারপর বেরিয়ে পড়ব শহর ঘুরতে। দেখার অনেক জিনিস আছে। তাছাড়া, কাগজে দেখলাম এক জায়গায় অ্যানটিক নিলাম হচ্ছে। ওখানে যাব। কিন্তু পছন্দও হয়ে যেতে পারে, কেনার ইচ্ছে আছে।
হাসল ছেলেময়েরা। ওরা জানে, পুরানো জিনিসের প্রতি খুব শখ মিসেস পারকারের, বিশেষ করে অ্যানটিক। বেছে বেছে দেখার মত জিনিস জোগাড় করে নিয়ে আসেন। নিলামের ব্যাপারে মায়ের যেমন আগ্রহ, মেয়ের তেমনি নিরাসক্তি। সে ভাবল–মা যাক নিলামে, আমরা চলে যাব অন্য কোথাও ঘুরতে। অনেক জায়গা আছে দেখার, যেগুলো সে দেখেনি। পরদিন সকালেই মাকে সেটা পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে, ঠিক করল।
সুতরাং পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে মাকে বলল জিনা, আমাদেরকে নিশ্চয় একা একা ঘুরতে দেবে, তাই না, মা?
দেবো, রাস্তাঘাট চেনা হয়ে যাবার পর, মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে
হাসলেন মা। তবে কথা দিতে হবে, খুব সাবধানে থাকবি।
থাকব, বলতে একমুহূর্ত সময় নষ্ট করল না জিনা।
আর গোলমাল বাধাবি না। ঝগড়া করবি না কারও সঙ্গে।