ওটা ওর অ্যাকাউন্ট বুক, বুঝতে পারল কিশোর।
আলমারির খোলা ফেলে রেখেই দোকানে গিয়ে ঢুকল আবার ম্যাকি। পরপর তিনদিন তার দোকানের ওপর চোখ রেখেছে গোয়েন্দারা, লোকটা এখন কি করছে বুঝতে অসুবিধে হল না কিশোরের। দোকানের ডেস্কে বসে দিনের বেচা-কেনার হিসেব করছে ম্যাকি। বাইরে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেই এখন যে কেউ তার কাজ দেখতে পাবে। দোকান বন্ধ করে যখন একবারে বেরিয়ে যায়, তখন লাগায় পুরানো ধাঁচের জানালার ধাতব পাল্লা।
লোকটা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে খোঁজা আরম্ভ করব, ভাবল কিশোর। আলমারিটার দিকে তাকিয়ে আরেকটা কথা জাগল মনে। যদি তালা লাগিয়ে দিয়ে যায় ম্যাকি? ওটার ভেতরে আর তখন দেখতে পারবে না সে। তবে কি এখনই…
ঝুঁকিটা নিল কিশোর। হাতুড়ি পিটতে শুরু করল যেন বুকের ভেতর। আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ওয়ারড্রোব থেকে। কান খাড়া রেখে পা টিপে টিপে এগোল আলমারির দিকে। কাছে এসে ভেতরে তাকাল। ছোট-বড় নানারকম বাক্স, গাদা গাদা খাম…আর কোণের দিকে ফ্যাকাসে নীল একটা বাক্স, হারটা যেটায় ছিল ওরকমই দেখতে। হাত বাড়াল কিশোর…
ঠিক এই সময় মচমচ করে উঠল চেয়ার। নিশ্চয় ম্যাকির। বোধহয় উঠে দাঁড়িয়েছে সে, ফিরে আসছে। তিন লাফে আবার ওয়ারড্রোবের কাছে চলে এল কিশোর। সে ঢুকে পড়ার সাথে সাথে ম্যাকিও ঢুকল ঘরে। আলমারিতে খাতাটা রেখে, ওটার দরজা খোলা রেখেই আবার চলে গেল দোকানে। জানালা লাগানোর শব্দ কানে এল।
লাগাতে বেশিক্ষণ লাগবে না। আবার আলমারির ভেতরটা দেখার সুযোগ চলে গেল। বেরোনোর সাহস করল না আর সে।
বেরোলে ভুলই করত, বুঝল খানিক পরেই। জানালা লাগিয়ে ফিরে এল ম্যাকি। ওয়ারড্রোবের দরজার ফাঁক দিয়ে কিশোর দেল, আবার আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা।
এইবার নিশ্চয় বন্ধ করে ফেলবে, ভাবল কিশোর।
না, বন্ধ করল না। বরং ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল নীল বাক্সটা। হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল একমুহূর্ত। তারপর খুলে বের করল টা। আঙুল বুলিয়ে দেখতে লাগল। যেন কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না ওটার ওপর থেকে।
হঠাৎ বেজে উঠল টেলিফোন। ঝট করে সেদিকে ফিরল ম্যাকি। তারপর তাড়াতাড়ি আবার হারটা বাক্সে ভরে আলমারিতে রেখে লাগিয়ে দিল দরজা। কিট করে তালা লেগে গেল।
গেল! ডাবল কিশোর। হারটা দেখলাম। জানি এখন কোথায় আছে, কিন্তু চেষ্টা করেও হাত লাগাতে পারব না!
শুনতে পেল ম্যাকির কণ্ঠ, টেলিফোনে কথা বলছে, হ্যালো, হেইকি? কি ব্যাপার? এই অসময়ে?…হা হা, বন্ধ করে দিয়েছি।উচিত হল না। দোকানে কাস্টোমার থাকতে পারত এখন। তাহলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে হত না? যাকগে, ভবিষ্যতে আর এভাবে ফোন করবেন না। যখন করতে বলব তখন করবেন। চালে সামান্য ভুল হলেই সব শেষ…কি বললেন?…না না, নিশ্চয়ই না। তবে সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।…আরে বাবা, এত দামি একটা জিনিস, পেয়েছি কিনা জানার জন্যে উদ্বিগ্ন তো হবেনই। সবাই হবে। তাই বলে হুঁশিয়ার থাকতে হবে না? যা-ই হোক, এভাবে আর ফোন করবেন না। আপনার বন্ধুদেরকেও মানা করে দেবেন।
নীরবে কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনল ম্যাকি, তারপর আবার বলল, শুনুন, আগেও বলেছি, আবার বলছি, মুক্তার নতুন চালান এল কিনা জানতে চাইলে সোজা চলে আসবেন। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললেই তো হয়ে যায়। ফোন করাটা সব সময়ই বিপজ্জনক। আপনিও তা বোঝেন, বার বার বলে দিতে হয় কেন? তো রাখি এখন। গুডবাই।
রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হল।
ওয়ারড্রোবের ভেতর দম বন্ধ করে বসে রইল কিশোর। বুঝতে পেরেছে, কতটা ভয়ঙ্কর লোকের ঘরে এসে ঢুকেছে। লোকটা শুধু ওই একটাই নয়, আরও অনেক মুক্তা চুরি করেছে। চোরাই মুক্তার ব্যবসা করে। ওরকম পেশাদার একজন লোক অবশ্যই বিপজনক।
ফিরে এল ম্যাকি। আবার খুলল আলমারি। আরেকবার বাক্স খুলে মুক্তাটা বের করে দেখল। তারপর রেখে দিয়ে দরজা লাগাল। এলোমেলো করে দিল তালার কম্বিনেশন নাম্বারগুলো।
ফাঁক দিয়ে দেখছে কিশোর, ওভারকোট পরল লোকটা। যাক, বেরোলে বাঁচা যায়। সে-ও বেরোতে পারবে। বাইরে নিশ্চয় অস্থির হয়ে উঠেছে তার বন্ধুরা।
বেরিয়ে গেল ম্যাকি। দোকানের সদর দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেরিয়ে এল কিশোর। এগোল ডিভানটার দিকে। তার জানা আছে, ওটার পেছনে নিচে নামার সিঁড়ি আছে, ওই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া যাবে মাটির নিচের ঘরে। ওখানে দোকানের স্টোররুম, মাল জমিয়ে রাখা হয়। বেশ কায়দা করে এই খবরটা জেনে নিয়েছে রবিন।
ঢুকেছে যখন সবকিছুই দেখে নিতে চায় কিশোর। সুযোগ সব সময় আসে। বলা যায় না কখন কোন তথ্যটা কাজে লেগে যাবে। সেলারের দেয়ালের ওপরে একটা ছোট জানালা, আলো আসছে ওটা দিয়ে। ওখানে পৌঁছতে পারলে ওটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে সে। জিনিসপত্রগুলো দেখল সে। সাধারণ জিনিস, দোকানে যা বেচাকেনা হয়। বিশেষ কিছু দেখার নেই। একটা পুরানো টেবিল টেনে এনে জানালার নিচে রাখল। উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কাউকে চোখে পড়ল না। বেরোতে খুব একটা কষ্ট হল না।
উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে বন্ধুরা।
এসেছ? বলে উঠল মুসা। আমরা তো ভাবছিলাম আটকাই পড়লে নাকি। তা কি দেখলে?