চলে গেছে লোকটা, মুসা বলল। ইচ্ছে করে পিছু নেয়নি। এদিকেই আসছিল হয়ত কোন কাজে।
এখন তা আর মনে হয় না আমার, মাথা নাড়ল কিশোর। মিসেস কলিনসকেই অনুসরণ করেছে সে। জিনা কাল দেখেছে, আজও দেখেছে। মিসেস কলিনসও দেখেছেন। চোখের ভুল আর বলা যাবে না।
ব্যাটা লুকিয়ে পড়ল নাকি কোথাও? মুসা বলল। বেরিয়ে দেখব?
না, দরকার নেই, তাড়াতাড়ি হাত নাড়লেন কেরিআন্টি। লোকটা খারাপ। শেষে কি করে বসে!
শুনুন, এরিনাকে বলল কিশোর, এখন যত তাড়াতাড়ি পারেন, গিয়ে হারটা কোন ব্যাংকের ভল্টে রেখে দিন।
তাই করতে হবে। আমি যেখানে থাকি তার কাছেই একটা ব্যাংক আছে।
তাহলে সোজা ওখানে চলে যান। একা যেতে পারবেন তো? নাকি আমরা। আসব আপনার সাথে? বলা যায় না, আপনাকে একা দেখলে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে ম্যাকি। তোক বেশি দেখলে সাহস, করবে না।
এলে তো ভালই হয়, খুশি হয়ে বলল এরিনা। তবে মিসেস পারকার যদি অনুমতি দেন।
গেলে যাক, আন্টি বললেন। তবে মনে হয় না কোন দরকার আছে। হাসলেন তিনি। ট্রেনে করে যান, তাতে বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না। তাছাড়া হারটা যে আপনার কাছে আছে, তা-ও জানছে না কেউ। বিপদ ঘটবে কেন?
বাক্সটা ব্যাগে ভরল এরিনা। মিসেস পারকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এল। ওদের সঙ্গে চলল তিন গোয়েন্দা, জিনা আর রাফিয়ান। রাস্তায় বেরিয়ে লোকটাকে খুঁজল ওরা। কোথাও দেখা গেল না ম্যাকিকে।
পাতালরেলের একটা স্টেশন রয়েছে কাছেই। সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে এল ওরা। রাফিয়ানকে এবারও ঝুড়িতে ভরে নেয়া হচ্ছে, তবে এটা আগেরবারের মত। আর ফোকর কাটা নয়। তাতে সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই বেশি। এই ঝামেলা পোহাতে আর রাজি নয় কেউ।
ট্রেন আসার অপেক্ষায় নীরবে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। উৎকণ্ঠায় ভুগছে এরিনা, কখন ব্যাংকে গিয়ে বাক্সটা রাখবে, তারপর নিশ্চিন্ত। তার আশেপাশে গোল হয়ে ঘিরে রেখেছে ছেলেমেয়েরা, বডিগার্ডের মত। মলির হাত ধরে রেখেছে রবিন। রাফিয়ানের ঝুড়ি মাটিতে নামানো।
ট্রেন এল। হাতে ব্যাগ আঁকড়ে ধরে প্ল্যাটফর্মের একেবারে কিনারে চলে এসেছে এরিনা। হঠাৎ পেছন থেকে ধেয়ে এল একটা লোক, এক থাবায় তার হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে, ধাক্কা মেরে তাকে প্রায় ফেলে দৌড় দিল। দুদিক থেকে এরিনাকে ধরে ফেলল.কিশোর আর মুসা, নইলে আরেকটু হলেই চলে যেত ট্রেনের চাকার নিচে।
যাত্রী নামছে, উঠছে, এই হুড়াহুড়ির মাঝে বেরোনোর পথের দিকে দৌড় দিল লোকটা। বেশির ভাগ মানুষই খেয়াল করল না ঘটনাটা, ট্রেনে উঠতেই ব্যস্ত ওরা। ঝুড়ির মুখ খুলে দিল জিনা। তাড়া করল লোকটাকে রাফিয়ান। পেছনে ছুটল মুসা।
দেখে মনে হয় ভবঘুরে ধরনের লোক, বুড়ো, রাফিয়ান তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই চিৎকার করে উঠল। পরমুহূর্তে তাকে ধরে ফেলল মুসা। কেড়ে নিল ব্যাগটা।
ডান হাতকে যেন বর্ম বানিয়ে মুখ আড়াল করতে চাইছে আতঙ্কিত লোকটা, বাঁ হাত কামড়ে ধরে ঝুলছে রাফিয়ান। এই সময় বেরিয়ে এল ষ্টেশনের একজন কর্মচারী। রাফিয়ানের কলার টেনে তাকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, সর, সর বলছি! শয়তান কুত্তা! মানুষ দেখলেই কামড়াতে ইচ্ছে করে? মুসার দিকে তাকাল সে। তোমার কুকুর, না? দাঁড়াও, মজা বুঝবে। লোকের ওপর কুত্তা লেলিয়ে দাও…।
বোঝানোর চেষ্টা করল মুসা। শুনলই না লোকটা। হ্যাঁচকা টান মারল রাফিয়ানের কলার ধরে। সুযোগটা কাজে লাগাল ভবঘুরে। চোখের পলকে ছুটে গিয়ে মিশে গেল লোকের ভিড়ে। হারিয়ে গেল।
এই ছেলে, কি বলছি শুনছ? রেগে গিয়ে বলল কর্মচারী।
এই সময় এখানে এসে দাঁড়াল কিশোর, রবিন, জিনা। মেয়ের হাত ধরে এল এরিনা। এখনও কাঁপছে। মলির চোখে পানি।
আমার কুকুর ধরেছেন কেম! ছাড়ুন! রাগে চিৎকার করে উঠল জিনা। চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি? দেখলেন না চোর ধরেছিল ও!
হ্যাঁ, ও-লোকটা আমার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিল, এরিনা বলল। আরেকটু হলেই দিয়েছিল আমাকে ট্রেনের নিচে ফেলে। ছেলেময়েগুলো না, থাকলে কুকুরটা না থাকলে, শিউরে উঠল সে, কথা শেষ করতে পারল না।
মুসার কথা কানে না তুললেও এরিনার কথা বিশ্বাস করা কর্মচারী। খুলে পড়ল নিচের চোয়াল। প্রায় তোতলাতে শুরু করল, তা-তাই নাকি, ম্যাম! আআমি কি করে জানব, বলুন…।
তাগাদা দিল কিলোর, এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করে লাভ নেই। জলদি চলুন, আগে গিয়ে ব্যাংকে রাখুন বাটা। তারপর নিরাপদ।
আবার ঝুড়িতে ঢোকানো হল রাফিয়ানকে। ট্রেন চলে গেছে। পরের ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হল ওদের। ট্রেনে কেউ আর কোন কথা বলল না। গন্তব্যে পৌঁছে বাইরে বেরোলো খুব সাবধানে। কিন্তু কাছেপিঠে সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়ল না।
কুইক! এরিনা বলল। পাশের গ্রীটেই আমার ব্যাংক।
হ্যাঁ হ্যাঁ, চলুন, জিনা বলল। আগে ব্যাংকে রাখুন হারটা। তারপর ম্যাকির ব্যবস্থা করছি।
ম্যাকি! আঁতকে উঠল এরিনা। বুড়োটাই ম্যাকি নাকি?
নিশ্চয়ই। ভবঘুরের হরবেশ নিয়েছে বটে, কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
তারমানে, রবিন বলল, বাড়ি থেকে বেরোনোর পরই আমাদের পিছু নিয়েছে সে?
আমার তাই মনে হয়, কিশোর বলল। পথের ধারে একটা খবরের কাগজের দোকান আছে না, তার আড়ালেই বোধহয় লুকিয়েছিল। পোশাক-আশাক খুব একটা বদল করতে হয়নি। যাটটা মুচড়ে নষ্ট করেছে। হাতে, মুখে আর কোটে ধুলো লাগিয়েছে, যাতে মনে হয় নোংরা ভবঘুরে। সে ভেবেছিল মিসেস কলিনস একলা আসবেন, তাঁকে ফাঁকি দিতে অসুবিধে হবে না।