ডিঙির সঙ্গে বাঁধা দড়িটা খুলে ছুঁড়ে দিল কিশোর। খপ করে ধরল ক্যাপ্টেন। তাড়াতাড়ি নিয়ে গিয়ে পেঁচিয়ে ফেলল ক্যাপস্ট্যানে।
জালের দুই মাথা-ই এখন শক্ত করে বাঁধা হয়েছে ক্যাপস্ট্যানের সঙ্গে। আটকা পড়েছে দানবটা, পালানোর পথ বন্ধ।
কারগো বুমটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সরিয়ে আনছে জামবু। প্রধান মাস্তুলের সঙ্গে লাগানো রয়েছে ওটা, এক মাথায় একটা বড় আঁকশি লাগানো। আঁকশিটা জালে আটকে দিল কিশোর।
চাল হয়ে গেল ইঞ্জিন। আঁকশিটা ওপরে উঠতে লাগল, সেই সাথে টেনে তুলতে লাগল জাল।
হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল কাকের বাসায় বসা রবিন। তার সঙ্গে গলা মেলাল বোটের আরোহীরা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খুশি হওয়া উচিত হয়নি ওদের। জালের মধ্যে ভীষণ দাপাদাপি শুরু করেছে ম্যানটা, এখন আর খেলাচ্ছলে নয়, মুক্তির জন্যে। ডানা ঝাড়ছে, লেজ দিয়ে বাড়ি মারার চেষ্টা করছে। শপাং করে এসে বোটে লাগল লেজের বাড়ি। নৌকার যেখানে লাগল, গুড়িয়ে গেল ডিমের খোসার মত।
কখন পানিতে পড়ল, বুঝতেও পারল না মুসা। মাথা তুলে চেয়ে দেখল, তার পাশেই হাবুডুবু খাচ্ছে কিশোর। দ্রুত ওকে টেনে নিয়ে সাঁতরে ম্যাটার কাছ থেকে সরে এল সে। ওপর থেকে দড়ি ছুঁড়ে দিল কলিগ। সেটা ধরে বেয়ে ডেকে উঠে এল দুজনে।
এতক্ষণে কুমালোকে দেখতে পেল ওরা। শয়তান মাছের লেজের বাড়ি খেয়ে বোধহয় বেহুঁশই হয়ে গেছে বেচারা। ভাসছে। রক্ত বেরোচ্ছে ক্ষত থেকে। ইতিমধ্যেই রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছে হাঙরেরা, দূরে ভেসে উঠেছে ওদের পিঠের পাখনা। পানি কেটে ছুটে আসছে তীব্র গতিতে।
একটানে কোমরের খাপ থেকে বড় ছুরি বের করল মুসা।
বাধা দিল ক্যাপ্টেন, যেও না! বাঁচাতে পারবে না।
দূর, মরুক না ডুবে, ঘৃণায় মুখ বাঁকাল জামবু। একটা কানাকার জন্যে মরবে নাকি গিয়ে?
দ্বিধা যাও বা সামান্য ছিল মুসার, জামবুর কথায় একেবারে দূর হয়ে গেল। রাগে জ্বলে উঠল সে। ডাইভ দিয়ে পড়ল রক্তাক্ত সাগরে। দড়িটা নিতে ভুলল না। ওটার মাথা কুমালোর বুকে পেঁচিয়ে বাঁধল।
হাজির হয়ে গেল একটা হাঙর। হাত লম্বা করে ছুরিটা সোজা করে ধরে রাখল মুসা। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় লাগল হাঙরের শরীরে। ওটার ঘাড়ের নিচ থেকে লেজের কাছাকাছি লম্বা হয়ে ফেড়ে গেল গভীরভাবে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। খাবি খেতে খেতে দৌড় দিল একদিকে, যন্ত্রণায় শরীর মোচড়াচ্ছে। মানুষের দিক থেকে নজর সরে গেল অন্যান্য হাঙরগুলোর। ছুটে গেল জাতভায়ের মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে।
দড়ি ধরে টেনে তুলে নেয়া হল কুমালোকে। পানিতে অপেক্ষা করছে মুসা, আবার দড়িটা এলে তারপর উঠবে। চোখ হাঙরগুলোর দিকে। কয়েক গজ দূরে আহত হাঙরের গা থেকে মাংস খুলে নিচ্ছে অন্যগুলো। দেখতে দেখতে শেষ করে ফেলবে।
মুসার মনে হল, কয়েক যুগ পরে তার পাশে এসে পড়ল দড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে ধরল। টেনে তুলে নেয়া হল ওকেও।
একবার মাত্র চোখ খুলল কুমালো, মুসাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্যে, তারপরই মুদে ফেলল। পড়ে রইল মড়ার মত। কাকের বাসা থেকে নেমে এসেছে রবিন। সে আর কিশোর মিলে কুমালোর জখম ধুয়ে মুছে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতে লাগল।
গেল একটা চমৎকার ডিঙি, পানির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যাপ্টেন। জালের মধ্যে এখনও দাপাচ্ছে ম্যানটা। পানিতে আলোড়ন তুলেছে। তাতে ডুবছে ভাসছে নৌকার ভাঙা কাঠগুলো। নৌকা ভাঙার সমস্ত ঝাল গিয়ে ওটার ওপর পড়ল কলিগের। চেঁচিয়ে বলল, তোলো ব্যাটাকে! যেন তুললেই বেত দিয়ে পেটানো শুরু করবে।
উঠে যাচ্ছে জাল। ওপরে, আরও ওপরে। কামড়ে কয়েক জায়গায় জাল কেটে ফেলেছে শয়তান মাছ। এছাড়া আর কোন ক্ষতি করতে পারেনি সাংঘাতিক শক্ত জালটার। দানব ধরার জন্যেই যেন তৈরি হয়েছে ওটা। জালটাকে নামিয়ে আনা হল ট্যাংকের মুখের কাছে।
ট্যাংকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আন্দাজ করে ফেলল কিশোর। নাহ, অসুবিধে কিছুটা হলেও জায়গা হয়ে যাবে ম্যানটার। সত্যিই হয়ে গেল। কিন্তু নতুন বাড়ি মোটেও পছন্দ হল না শয়তান মাছের। আবার শুরু করল দাপাদাপি। ছিটিয়ে সমস্ত পানি ফেলে দিতে লাগল বাইরে। চালু করে দেয়া হল পাম্প, পালি, ভরতে লাগল ট্যাংকে। বড় ঢাকনাটা লাগিয়ে দেয়া হল, যাতে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারে অতিকায় প্রাণীটা।
ট্যাংকের দেয়ালে মোটা কাচে ঢাকা জানালা রয়েছে। সবাই হুড়াহুড়ি করে এসে চোখ রাখল তাতে, ভেতরে শয়তান মাছ কি করে দেখার জন্যে।
শান্ত হয়ে গেছে জায়ান্ট রে। ট্যাংকের তলায় বিছিয়ে রয়েছে মস্ত এক কালো চাঁদরের মত। জালটা এখনও জড়ানোই রয়েছে শরীরে।
খুলবে কি করে ওটা? রবিন জিজ্ঞেস করল।
দানবটার সঙ্গে আরেকবার ধস্তাধস্তি করার কোন ইচ্ছেই নেই কিশোরের। বলল, থাক, জালের মধ্যেই। বের করতে সুবিধে হবে। আশা করি দিন দুয়েকের মধ্যেই হনুলুলু পৌঁছবে। তখন কোন একটা মালবাহী স্টীমারে তুলে দেব, লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছে দেবে। ট্যাংকটা দরকার আমাদের। আরেকজনের জন্যে খালি করতে হবে।
কার জন্যে? অক্টোপাস?
হয়ত। মুসা, জনাব শয়তানের বাবুর্চি নিযুক্ত করা হল তোমাকে। জন্তুজানোয়ারকে খাওয়ানোর ব্যাপারটা তুমিই ভাল বোঝ। যত পার মাছ খাওয়াবে।