কিশোরের বিস্ময় দেখে হাসল কলিগ। তারপর? কাছে তো এলাম, এখন কি করা?
একটাকে জ্যান্ত ধরতে চাই।
খেত খোত করে নাক টানল ক্যাপ্টেন। তা পারবে না। মেরে হয়ত ভোলা যায়, জ্যান্ত ধরতে পারবে না। হারপুন বের করতে বলব?
না। কিশোর চেঁচিয়ে আদেশ দিতে আরম্ভ করল বড়দের মত করে, মুসা, কুমালো, জলদি নিচে থেকে বড় জালটা নিয়ে এস। জামবু, ডিঙি নামাও। ক্যাপ্টেন, জাহাজ সোজা রাখুন, নড়েচড়ে না যেন।
ভুরু কুঁচকে ফেলল কলিগ। কি করতে চাও?
বড় দেখে একটাকে ধরব। জালের একমাথা জাহাজে বেঁধে, আরেক মাথা। ডিঙিতে ধরে রেখে বেড় দেব।
পাগল…, থেমে গেল ক্যাপ্টেন। তার কথা শোনার জন্যে ওখানে দাঁড়িয়ে নেই কিশোর। বিড়বিড় করল সে, ছেলেটার মাথা খারাপ!
ভারি জালের একমাথা শক্ত করে বাঁধা হল জাহাজের ক্যাপস্ট্যানের সঙ্গে। জালের বাকি অংশ ডিঙিতে ফেলে তাতে উঠে বসল কিশোর, মুসা আর কুমালো। দাঁড় বেয়ে সরে যেতে লাগল জাহাজের কাছ থেকে, ধীরে ধীরে পানিতে পড়ছে জাল।
জালটা যখন পুরোপুরি পড়ে সারল, ডিঙি তখন জাহাজ থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে। জালের আরেক মাথা শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল ডিঙির ছোট একটা খুঁটির সঙ্গে, নোঙরের দড়ি বাঁধা হয় যেটাতে।
চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে জালে এসে ঠেকল বড় একটা ম্যানটা, ওটাকে নিশানা করেই ফেলা হয়েছে জাল। এরপর যা ঘটল এমনটি ঘটবে কল্পনাও করতে পারেনি কেউ।
ঘুরে এল ম্যানটা। নৌকাটাকে দেখলই না যেন। কাছে থেকে আরও বড় আরও ভয়ঙ্কর মনে হল ওটাকে। পানি থেকে উঠে রয়েছে জালের ওপরের অংশ।
কি করে যেন বুঝে গেল শয়তান মাছ, বাধা আছে সামনে। গতি কমাল না, বরং বাড়িয়ে দিল। বাড়ছে, বাড়ছে…স্পীডবোটের মত শা শা করে ছুটছে পানি কেটে।
তারপর হঠাৎ লাফ দিল শূন্যে। নিখুঁতভাবে জালটাকে পেরিয়ে গেল দশ ফুট ওপর দিয়ে। মনে হল, ঝড়ে উড়ে গিয়ে পড়ল একটা গ্যারেজের দরজা। বুমম করে বিকট শব্দ হল পানিতে পড়ার, যেন নেভির পাঁচ ইঞ্চি কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে।
পানিতে পড়েই আবার ছুটতে শুরু করল ম্যানটা, নতুন একটা চক্র রচনা করছে। তার উত্তেজনা সংক্রমিত হল অন্য দানবগুলোর মাঝেও, একের পর এক শূন্যে লাফিয়ে উঠতে লাগল ওগুলো, পানিতে পড়ছে প্রচণ্ড শব্দ তুলে। পড়েই, ডিগবাজি খেয়ে চিত হয়ে যাচ্ছে কোন কোনটা, রোদে ঝিক করে উঠছে সাদা পেট।
কৌতূহলী হয়ে উঠেছে নৌকাটাকে দেখে, দেখতে আসছে কাছে থেকে।
ব্যাটারা দল বেঁধে হামলা চালাবে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
ক্যাপ্টেনের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে কিশোর। বন্ধ উন্মাদই কেবল ডিঙি নিয়ে আটাশটা শয়তান মাছের ঝাঁকে নামার কথা ভাববে। কিংবা বোকা লোকে, জায়ান্ট রে সম্পর্কে যার কোন জ্ঞান নেই।
আরেকটা ম্যানটা এগোচ্ছে জালের দিকে। কাছাকাছি গিয়ে লাফিয়ে না পেরিয়ে শাঁ করে মোড় নিয়ে সোজা ছুটে আসতে লাগল নৌকার দিকে। হঠাৎ বুঝি চোখে পড়ল সামনের ডিঙিটাকে। লাফ দিল শূন্যে।
আরোহীদের চোখের সামনে থেকে সূর্য আড়াল করে দিল যেন একটুকরো কালো মেঘ। মাথা নিচু করে ফেলেছে কিশোর। ভাবছে, এখুনি বিশাল বপু নিয়ে ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে দানবটা। মুসাও মাথা নুইয়ে ফেলেছে। শুধু কুমালো পাটাতনের ওপরে বসে আছে হাসিমুখে, শান্ত। কারণটা বোঝা গেল। ডিঙিতে পড়ল না ম্যানটা। উড়ে গিয়ে পড়ল আরেকপাশে পানিতে। চাবুকের মত লেজটা বাড়ি লাগল নৌকার পাশে, গভীর একটা ক্ষত করে দিল।
কাছে এসে গভীর আগ্রহে নৌকাটাকে দেখছে আরেকটা শয়তান মাছ। আস্তে ডানা তুলে ছুঁয়ে দেখল, তাতেই থরথর করে কেঁপে উঠল ডিঙি। জোরে বাড়ি দিলে কি হত কে জানে! হঠাৎ ছুটতে শুরু করল, ঘুরে এগিয়ে যাচ্ছে জালের দিকে।
পেয়েছি ব্যাটাকে! চিৎকার করে বলল কিশোর।
যদি নতুন কোন কাণ্ড না করে, মাথা তুলল মুসা।
আমার মনে হয় শুধু এগোতেই পারে ওরা, পিছাতে পারে না।
পিছানোর কোন লক্ষণও দেখাল না ম্যানটা। তবে জালের কাছে গিয়ে মসৃণ ভঙ্গিতে তুলে ফেলল একটা ডানা, তারপর আরেকটা, নিখুঁত ভাবে জাল এড়াল। কিন্তু লেজটা বাঁধল বিপত্তি। জালের খোপে ঢুকে গেল। লেজের ডগায় বসানো কাঁটাগুলো আটকে গেল বড়শির মত।
বাও! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
ঝপাত করে পানিতে পড়ল দুই জোড়া দাঁড়। প্রাণপণে বেয়ে চলল মুসা আর কুমালো, জাহাজের দিকে ছুটল ডিঙি নিয়ে। দানবটার ওপর দ্রুত চেপে আসতে লাগল জাল।
কিন্তু এত সহজে ধরা দেয়ার পাত্র নয় শয়তান মাছ। দাপাদাপি শুরু করল। সে তো আর চুনোপুঁটি নয়, পানির মহারাজ। তার দাপাদাপিতে ফুলেফেঁপে উঠল পানি, প্রচণ্ড ঘূর্ণি, অসংখ্য ফোয়ারা, ভিজিয়ে চুপচুপে করে দিল ডিঙির তিন আরোহীকে। দেখতে দেখতে পানিতে ভরে গেল ডিঙির খোল ডুবে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে এখন খুদে নৌকা।
ভাগ্য ভাল, বুদ্ধি করে নৌকার সঙ্গে জাল বাধা হয়েছিল। ধরে রাখলে সর্বনাশ হত। হ্যাঁচকা টান লেগে একবার এদিকে ঘুরছে ডিঙি, আবার ওদিকে। কয়েকবার কাত হয়েও সোজা হয়ে গেল। আর সামান্য কাত হলেই যেত উল্টে।
অবশেষে জাহাজের কাছাকাছি চলে এল নৌকা। রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে ক্যাপ্টেন, চোখ বড় বড়, কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে বুঝি। জালের দড়িটা দাও আমার হাতে! চেঁচিয়ে বলল সে। কুইক!।