গারনারড, বলল সে। ফ্লাইং গারনারড! মুসা, তোমার কপাল ভাল, বেঁচে গেছ। এই মাছের অনেক গল্প পড়েছে কিশোর। রাতের বেলা হুইল ধরে থাকা নাবিকের কপালে এসে বাড়ি খায় এই মাছ। প্রচণ্ড আঘাতে বেহুশ হয়ে যায় নাবিক, মারাও যায় কখনও কখনও।
রক্ত পড়ছে মুসার পেট থেকে। শার্টের বোতাম খুলে দেখা গেল, গারনারডের ছুরির মত ধারালো আঁশ কাপড় কেটে চামড়ায় আঁচড় দিয়েছে।
আলাদা একটা ট্যাংকে গারনারডকে রেখে দিয়ে এল কিশোর। তারপর সে আর রবিন মিলে মুসার সেবা করতে বসল। অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করে তাতে মলম লাগিয়ে দিল।
উঠে দাঁড়াল মুসা। তিনজনে মিলে নতুন প্রাণীটাকে দেখতে গেল।
মিস্টার লিসটারের খুব পছন্দ হবে, খুশি হয়ে বলল কিশোর। আস্ত একটা ভড়। উড়তে পারে, সাঁতরাতে পারে, এমন কি হাঁটতেও পারে।
সত্যি, ট্যাংকের তলায় হেঁটে বেড়াচ্ছে গারনারড। পেটের নিচের দুটো পাখনাকে ব্যবহার করছে পায়ের মত। কয়েকটা শান্ত কদম ফেলেই কুইক মার্চ শুরু করে। তারপর ডাবল মার্চ, তারপর একেবারে দৌড়। দৌড়ানোর সময় সামনে লতা-টতা পড়লে একটা পাকে নিমেষে হাত বানিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয় লতাটা। খাবার দেখলে থমকে দাঁড়ায়। ঠোকর দিয়ে তুলে নিয়ে গল্প করে গিলে ফেলে।
কাণ্ড দেখে হেসে উঠল মুসা, পরক্ষণেই আউক! করে চেপে ধরল পেট। হাসতে গিয়ে ব্যথা লেগেছে। সামলে নিয়ে বলল, একেবারে সার্কাসের ভাড়। ঠিকই বলেছ, লিসটারের পছন্দ হবে। তবে ট্যাংকের মুখ ভোলা রাখলে কাঁদতেও দেরি হবে না, উড়ে এসে যখন পেটে গুতো লাগাবে। পেটে হাত রাখল সে। আল্লায় না করুক, আমার অবস্থা না হোক ভদ্রলোকের। কিন্তু যদি হয়, আল্লাহ্, আমি যেন তখন থাকতে পারি ওখানে।
৫
বাদুড়! বাদুড়! পরদিন সকালে কাকের বাসা থেকে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। গ্যারেজের দরজার সমান একেকটা!
।রবিন মিথ্যে বলে না, তবু বিশ্বাস করতে পারল না মুসা। বাদুড় পানিতে সাঁতার কাটে না। আর গ্যারেজের দরজার সমান বড়ও হয় না। কিন্তু রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হল। বিশাল কালো ডানা নেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠছে প্রাণীটা, আবার ঝুপ করে পড়ছে পানিতে।
ঘোষকের পদটা দেয়া হয়েছে রবিনকে। দিনের বেশির ভাগ সময়ই কাকের বাসায় বসে থাকে, চোখ রাখে সাগরের দিকে। আকর্ষণীয় কোন প্রাণী দেখলেই চিৎকার করে জানায়। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে ছোটে জাহাজ। কাছে গিয়ে, যদি দেখা যায়, ধরার উপযোগী, তাহলে ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়।
হাত তুলে যেদিকে দেখাচ্ছে রবিন, সেদিকে জাহাজের মুখ ঘোরাল কলিগ। বিনকিউলার নিয়ে ছুটে এল কিশোর। মুসা তো বিশ্বাস করতে পারেনি না দেখে, দেখেও করতে পারল না। কী ওগুলো? জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেনকে।
সাগরের বাদুড়। জেলেরা বলে শয়তান মাছ।
কালো একঝাঁক দানব খেলা জুড়েছে পানিতে। দেখেই বুঝল কিশোর, এই জিনিসই চান লিসটার, তার চাহিদার তালিকায় রয়েছে এর নাম। ম্যানটা। আরেকটা নাম আছে এগুলোর, জায়ান্ট রে।
কিন্তু ধরবে কিভাবে? ট্যাংকে জায়গা হবে?
কাছে গিয়ে দেখা গেল, খেলছে না ম্যানটাগুলো। মাছ ধরে খাচ্ছে। কাছের বিশেষ একটা ম্যানটার ওপর নজর দিল ওরা। কাত হয়ে একটা সাঁতার কাটছে পানিতে, একটা ডানা পানির ওপরে, আরেকটা নিচে। এক ডানার মাথা থেকে আরেক ডানার মাথা বিশ ফুটের কম না। মাথা থেকে লেজের ডগা আঠারো ফুট। একঝাঁক মুলেটকে তাড়া করেছে ওটা।
মুখের দুপাশে দুটো লম্বা চ্যাপটা ডানার মত, কিংবা হাতও বলা যায়। ওগুলো দিয়ে মাছ ধরে ধরে ঠেলে দিচ্ছে মুখের ভেতর।
আর কি একখান মুখ! চার ফুট চওড়া। দুটো মানুষকে এক লোকমায় ঢুকিয়ে ফেলতে পারবে মুখের ভেতর।
কিন্তু কিশোর জানে, জায়ান্ট রে মানুষখেকো নয়। মাছই পছন্দ।
মানুষ খায় না বলেই যে নিরীহ, তা নয়। ভীষণ বিপজ্জনক। শোনা যায়, শূন্যে লাফিয়ে উঠে ডানা ছড়িয়ে ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ে নৌকার ওপর। দুই টনী দেহটা দিয়ে চেপে, বাড়ি মেরে গুড়িয়ে দেয় নৌকা, মেরে ফেলে আরোহীদের। চাবুকের মত লেজের বাড়ি ছুরির মত কেটে বসে চামড়ায়। কোন কোন সময় শূন্যে না উঠে নিঃশব্দে নৌকার তলায় চলে আসে ম্যানটা, তারপর ভেসে উঠে নৌকা উল্টে দেয়। আরোহীরা পড়ে গেলে ওদের মাঝে দাপাদাপি করতে থাকে। এতে মারা যায় মানুষ। যাদের ভাগ্য ভাল তারা জখম হয়।
মানুষকে ভয় করে না এরা। হয়ত ভয় করার মত বুদ্ধিই নেই। কিংবা হয়ত নিজের ক্ষমতার ওপর প্রচণ্ড বিশ্বাস। কখনও কখনও নৌকার সঙ্গে সঙ্গে মাইলের পর মাইল সাঁতরে চলে যায়, সামনে আসে, পেছনে যায়, পাশে সাঁতরায়, মাঝে মাঝে লাফিয়ে চলে যায় নৌকার একপাশ থেকে আরেক পাশে, আরোহীদের মাথার ওপর দিয়ে। দাড়ের বাড়ি যেন ওদের গায়েই লাগে না, ব্যথা পায় বলে মনে হয় না।
জাহাজ থেকে একবার একজন লোক একেবারে ম্যানটার মুখের ভেতর পড়ে গিয়েছিল। মানুষের স্বাদ মোটেও পছন্দ হয়নি ওটার, থুথু করে ছিটিয়ে ফেলেছিল। দানবটার নিচের পাটির দাঁতে লেগে চামড়া ছড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি লোকটার।
জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে পালে হাওয়া লাগানো কমালো কলিগ। ধীরে ধীরে ভেসে এসে থামল ম্যানটার ঝাঁকের ভেতর। ঝুলে পড়েছে পাল, পতপত করছে অলস ভঙ্গিতে। দুপাশে পানিতে উঠছে নামছে বড় বড় কালো ডানা। জাহাজটার সান্নিধ্য যেন পছন্দ হয়েছে দানবগুলোর। সঙ্গ ভালবাসে ওরা। সেজন্যেই দলবেঁধে থাকে অনেক সময়। গুনে ফেলল কিশোর। মোট আটাশটা ম্যানটা।