কেন? পানিতে তো রোদের আলো ঢোকে। দিনের বেলা যতবার ডুব দিয়েছি, আলো দেখেছি। অন্ধকার তো ছিল না?
সূর্যের আলো পানিতে হাজার ফুটের বেশি নামতে পারে না, বিদ্যে ঝাড়তে আরম্ভ করল বইয়ের পোকা রবিন। তুমি আর কয় ফুট নাম? বেশি গভীরে নামতে চাইলে, মানে ডীপ-সী ডাইভিঙের সময় আলাদা আলো নিয়ে যেতে হয় সঙ্গে করে। পানির মাইলখানেক নিচে থেকে শুরু হয় অন্ধকারের রাজত্ব, ঘোর কালো অন্ধকার, ওই যে কিশোর বলল, অমাবস্যা। হেসে যোগ করল, শোনের ভূতের মতই ওখানে আলো বয়ে বেড়ায় মাছেরা।
গায়ে কাঁটা দিল মুসার। খানিকটা সরে বসল দুই বন্ধুর কাছাকাছি। লেজের আলো জ্বলে-নেভে কেন?
বোধহয় শত্রুকে ঠেকানোর জন্যে, কিশোর বলল। তোমার চোখে হঠাৎ টর্চের আলো ফেললে কি হয়? অন্ধ হয়ে যাও না? ঠিক তেমনি। শত্রুর চোখে আলো ফেলে তাকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধ করে দেয় আলোক মাছ। ওই সুযোগে পালায়।
মম, খুব চালাক ব্যাটারা।
নানারকম জাল বেঁধে রাখা হয় জাহাজের পেছনে। কখনও ওপরের পানি থেকে মাছ ঘেঁকে তোলার জাল, কখনও গভীর পানি থেকে মাছ ধরার উপযোগী জাল। তাতে প্রতিদিনই ধরা পড়ে নানারকম মজার মজার জীব, মাছ।
গভীর পানির ছোট ছোট জীবগুলোকে ধরে ছোট একটা অ্যাকোয়ারিয়ামে আলাদা করে রেখে দেয় কিশোর।
দাঁড়াও, মজা দেখি, বলে ছোট একটা জাল দিয়ে আলোক মাছটাকে তুলে অ্যাকোয়ারিয়ামে ফেলল সে। সঙ্গে সঙ্গে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হল। তেড়ে এল ওটার চেয়ে বড় প্রজাতির আরেকটা আলোক মাছ, ওটার গায়েও আলো আছে। পাখাগুলোতেও আলো। এমনকি লম্বা লম্বা গোঁফগুলো থেকেও উজ্জ্বল দ্যুতি বেরোচ্ছে।
এটার নাম রাখেকো, কিশোর বলল।
দেখেই বোঝা যায়, জীবনে অনেক তারা গিলেছে, মন্তব্য করল মুসা। তাকিয়ে আছে ট্যাংকের দিকে। জলদি লণ্ঠন বের না করলে একেও খাবে।
লণ্ঠনটাকে প্রায় ধরে ফেলেছে তারাখেকো, এই সময় ওটার চোখের কাছে লেজ নাড়ল লণ্ঠন। দপদপ করে বার কয়েক আলো জ্বলল-নিভল। ধাধিয়ে দিল তারাখেকোর চোখ। দ্বিধায় পড়ে গেল বড় মাছটা। এই সুযোগে ট্যাংকের একেবারে কোনায় চলে গেল ছোটটা, লুকানোর চেষ্টা করছে।
ট্যাংকে আরও অনেক মাছ আছে। কোনটার সবুজ আলো, কোনটার হলুদ, কোনটার লাল। একটার মাথা থেকে বাঁকা হয়ে ঝুলছে সরু একটা আঁকশি, মাথায় খুদে একটা বাল্ব, জ্বলছে।
কিন্তু একটা মাছের কোন আলো নেই, অথচ গভীর পানিতে বাস। ম্যানুয়েল পড়ে জেনেছে কিশোর, ওটা চির অন্ধ। কাজেই কোথায় যাচ্ছে দেখার জন্যে আলো দরকার হয় না, অন্ধ মানুষের মত লাঠি দিয়ে দেখে দেখে চলে। তবে মানুষের হাতে থাকে একটা লাঠি, আর এটার শরীরে রয়েছে বিশটা। লম্বা লম্বা, ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। এগুলো দিয়ে মাছটা বোঝে কে কোথায় রয়েছে, কি করছে। চলার পথে কারও সঙ্গে ধাক্কা লাগায় না, বুঝতে পারে কোথায় রয়েছে খাবার, কোথায় শত্রু।
কিছু কিছু মাছের নাম ম্যানুয়েলেও নেই। একটা খাতায় ওগুলোর ছবি এঁকে রাখে কিশোর, পাশে নোট লেখে। বাড়িতে ফিরে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই ঘেঁটে দেখবে, ওগুলোর উল্লেখ আছে কিনা। না থাকলে বুঝবে, তিন গোয়েন্দাই ওগুলোর আবিষ্কারক। হয়ত ওদের নামেই নাম রাখা হবে মাছগুলোর, কে জানে!
রোমাঞ্চিত হল গোয়েন্দাপ্রধান। ওরা আবিষ্কারক? বিশ্বাসই হতে চায় না। তবে ব্যাপারটা অসম্ভব নয়। উনিশশো একান্ন সালে বিকিনি অ্যাটলের কাছে মাছের ওপর গবেষণা চালিয়েছিল স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন। চারশো একাশি প্রজাতির মাছের নমুনা সংগ্রহ করেছিল ওরা, তার মধ্যে উনআশিটাই নতুন। তারমানে প্রতি ছটায় একটা। ইস, এখনও যদি তাই হত! ট্যাংকের প্রতি ছটা মাছের একটা…
ধুম করে একটা শব্দে চমকে উঠল কিশোর, ছিন্ন হয়ে গেল ভাবনা। মাথার ওপরে মাস্তুলের গায়ে বাড়ি খেয়ে শব্দটা হয়েছে, ডেকে পড়ল কি যেন। ধুম ধুম করে আরও দুবার শব্দ হল।
উড়ুক্কু মাছ! চেঁচিয়ে উঠল সে। ট্যাংকে রাখা লণ্ঠন মাছের আলো গিয়ে পড়েছে সাদা পালে। ওই আলো দেখেই আকৃষ্ট হয়েছে উড়ুক্কু মাছ। উড়ে আসছে। আলো দেখে ছুটে আসা পতঙ্গের মত।
দাঁড়াও, ধরছি ব্যাটাদের! মাস্তুলের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল মুসা। কালো একটা জিনিস ছুটে আসছে। বেসবলের মত খপ করে ধরল ওটাকে। আওয়াজ শুনে ডেকে উঠে এসেছে কুমালো। তার হাতে মাছটা তুলে দিল সে। একইভাবে আরেকটা মাছ ধরল মুসা। তারপর আরেকটা। চমৎকার! সকালের নাস্তা ভালই। জমবে। উড়ুক্কু মাছের স্বাদ ভাল।
একটার পর একটা ধরছে মুসা। এই সময় উড়ে এল যেগুলো ধরেছে তার চেয়ে বড় একটা কিছু। মিস করল মুসা, কারণ শেষ মুহূর্তে গতি পরিবর্তন করেছে ওটা। ধ্যাপ করে পেটে এসে গুতো মারল। মনে হল, যেন হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরেছে। সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল তার শরীর। ডেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। পেট চেপে ধরেছে দুহাতে, প্রচণ্ড ব্যথা।
তাড়াতাড়ি ট্যাংকের ঢাকনা লাগিয়ে দিল কিশোর। ঢেকে দিল আলোক মাছের আলো, যাতে আর কেউ আকৃষ্ট না হয়। ফিরে এসে ঝুঁকল মুসার ওপর।
বিড়বিড় করছে মুসা, আল্লাহ্, মেরে ফেলেছে…।
মুসার পেটের কাছে বড় একটা পাথরের মত জীবকে পড়ে থাকতে দেখল কিশোর। টর্চের আলো ফেলল ওটার ওপর। মাছই। যেন বিচিত্র বর্ম পরে রয়েছে।