জবাব দিল না কিশোর। সরে এল ওখান থেকে। জাহাজের পালে হাওয়া লাগার পর থেকে যে ভাল লাগাটা ছিল, দূর হয়ে গেছে, মনের কোণে ভারি হয়ে উঠছে সন্দেহের কালো মেঘ।
প্রায় ভুলেই গিয়েছিল কালো সেডানের সেই লোকটার কথা। বাড়ি থেকে বন্দর পর্যন্ত কেউ তাদেরকে অনুসরণ করেনি। জাহাজ খোলা সাগরে বেরিয়ে আসার পর সে মনে করেছিল, শয়তানকে পিছে ফেলে এসেছে। সামনে শুধুই আনন্দ, আর রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার।
এখন মনে হল, ভুল করেছে। নতুন করে তাকে ভাবিয়ে তুলল ক্যাপ্টেন ইজরা কলিগ। জামবুকে সন্দেহ করল, লোকটা কেন আসল নাম বলতে চায় না? সন্দেহ হল কুমালোকে, লোকটা কি সত্যিই দেশে ফিরে যাওয়ার জন্যে শুকতারায় উঠেছে? নাকি দক্ষিণ সাগরে ওদের সঙ্গে চলেছে প্রফেসরের মুক্তা খেতের সন্ধানে? কাকে ছেড়ে কাকে সন্দেহ করবে বুঝতে পারছে না সে। জামবু আর কুমালো, দুজনকেই চাকরি দিয়েছে ইজরা কলিগ। তিনজনই কি একদলে?
কি হল? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
হাসল কিশোর। তার সন্দেহের কথা বলে এখনই দুই সহকারীকে ঘাবড়ে দিতে চায় না। না, কিছু না…ঝড়ের কথা শুনে ভাবছি…ওই দেখ, মেঘ।
বিশেষ সুবিধের লাগছে না, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে একটুকরো কালো মেঘ। নামবেই বোধহয়। তার কথা শেষ হতে না হতেই ঝরঝর করে ঝরে পড়ল কফোঁটা। বোঝা যায়, আরও ঝরবে।
বৃষ্টি! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। তারমানে গোসল। খাইছে, গায়ে যা গন্ধ হয়ে গেছে না। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর আর গা ধোঁয়ার সুযোগ পাইনি।
ছুটে কেবিনে চলে গেল সে। খানিক পরেই বেরিয়ে এল কাপড় খুলে, পরনে শুধু একটা জাঙ্গিয়া। হাতে সাবান।
বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। শরীর ভিজিয়ে নিয়ে সাবান দিয়ে জোরে জোরে গা ঘষতে শুরু করল মুসা। সাদা ফেনায় ঢেকে ফেলল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ইতিমধ্যে কমে গেছে বৃষ্টি। আবার নামার অপেক্ষা করতে লাগল সে উৎকণ্ঠিত হয়ে। চোখ বোজা। দেখতে পেল না, মাথার ওপর থেকে সরে গেছে। মেঘের টুকরোটা। একটা ফোঁটাও পড়ছে না আর।
সাবানের ফেনার একটা স্তম্ভ হয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে মুসা। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে কিশোর আর রবিন। কলিগও তাকিয়ে আছে, মজা পাচ্ছে।
আরেকটু মজা করার লোভ ছাড়তে পারল না রবিন। হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, মুসা, দেখ দেখ!
কি হয়েছে দেখার জন্যে চোখ মেলল মুসা। প্রায় সাথেসাথেই বন্ধ করে ফেলল আবার। চোখে সাবান ঢুকে জ্বলুনি শুরু হল। চেঁচাতে শুরু করল সে, ওরে বাবারে, গেছি! এই এই, আমাকে এক বালতি পানি এনে দাও না কেউ! অ্যাই…।
কেউ পানি আনতে গেল কিনা দেখারও উপায় নেই। সহ্য করতে পারল না আর মুসা। সোজা ছুটে গেল রেলিঙের কিনারে। থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত। তারপরই রেলিঙ টপকে মাথা নিচু করে ঝাপ দিল সাগরে।
ধুয়ে গেল সাবান। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে, পানি বেশ ঠাণ্ডা। কয়েক মুহূর্ত দাপাদাপি করল মুসা। তারপর ওপরে তাকিয়ে রবিনের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, রবিন। পানিতে নামার সাহস করতে পারছিলাম না, নামিয়ে দিয়ে ডর ভেঙেছ। চমৎকার পানি। এই কিশোর, নামবে নাকি?
না, হাত নাড়ল কিশোর। উঠে এস, জলদি। বড় বড় হাঙর থাকে এসব অঞ্চলে।
থাকুকগে। হাঙরকে ভয় পাই না আমি।
হাসল কিশোর। মুসার সাগরপ্রীতির কথা জানা আছে তার। হঠাৎ চোখ বড় বড় করে অভিনয় শুরু করল, ও, জানো না বুঝি? সাগরের পানিতেও ভূত থাকে। ওদের বলে খ্যাংড়া ভূত…
ঠিক এই সময় বোধহয় পায়ে একটা মাছের বাড়ি লাগল, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল মুসা, ওরে বাবারে! খেয়ে ফেলল রে! খ্যা-খ্যা-এ্যাংড়া ভূত…জলদি একটা দড়ি দাও! তোল আমাকে!
৪
রাত নেমেছে সাগরে। ডেকে বসে পড়ছে রবিন আর কিশোর। মাছের আলোয়।
একধারে বসে আকাশের তারা গুনছে মুসা।
ছোট একটা ট্যাংকের দুধারে বসেছে কিশোর আর রবিন। ট্যাংকের পানিতে সাঁতার কাটছে মাছটা, গা থেকে উজ্জ্বল আলো বেরোচ্ছে, চল্লিশ ওয়াট বাল্বের সমান আলো।
কি, পেয়েছ? মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল রবিন। নাম আছে?
আছে, হাতের ম্যানুয়েলটা নেড়ে বলল কিশোর। লণ্ঠন মাছ। বেশ মানিয়ে নাম রেখেছে।
মাছটার শরীরের দুধারে দুই সারি আলো, যেন খুদে একটা স্টিমারের আলোকিত জানালা। পিঠের ঘন কাটার ফাঁকে ফাঁকেও রয়েছে আলো.। নাগাড়ে জ্বলছে, মিটমিটও করছে না। তবে লেজের আলোগুলো স্থির নয়, জ্বলছে-নিভছে, জ্বলছে-নিভছে।
মাছটা ধরেছে কিশোর। ঘন্টাখানেক আগে পুলপিটে দাঁড়িয়েছিল জাল হাতে। পুলপিটের লোহার রেলিঙে হেলান দিয়ে তাকিয়েছিল নিচে, তন্ময় হয়ে দেখছিল নিচের জলজ জীবন। পায়ের তলায় মাত্র কয়েক ফুট নিচে ছুটন্ত সাগর। হঠাৎ দেখেছে আজব আলো। চোখের পলকে লাঠিতে বাঁধা জালটা ডুবিয়ে দিয়েছে পানিতে। চামচ দিয়ে শুরুয়া থেকে গোশতের টুকরো তোলার মত করে জালে করে তুলে এনেছে মাছটা।
এই আলো দিয়ে কি করে ওরা? জিজ্ঞেস করল মুসা। আকর্ষণীয় আলোচনা শুরু হয়েছে, কাজেই তারা গোনা বাদ।
গভীর পানির মাছ এটা, ম্যানুয়েল পড়ে জেনেছে কিশোর। শুধু রাতের বেলা ওপরে ওঠে। দিনে থাকে গভীর পানিতে, অন্ধকারে। সাগরের ওই অতোখানি গভীরে চিরকাল অমাবস্যার অন্ধকার। কাজেই ওখানে যারা বাস করে তাদের আলো দরকার হয়, এই আলোক মাছের মত।