ডেকে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। এরকম একটা জাহাজের সাময়িক মালিক হতে পেরে গর্বে ফুলে উঠেছে বুক। নৌকা-জাহাজ সম্পর্কে মুসার জ্ঞান বেশি, স্কুনারটা সে-ই পছন্দ করেছে। টাকা এসেছে তার বাবার পকেট থেকে অর্ধেক, বাকিটা কিশোরের চাচা রাশেদ পাশার কাছ থেকে। দুজনে শেয়ারে ব্যবসা করে, জন্তুজানোয়ার ধরে বিক্রি করার, স্কুনারটার মালিক ক্যাপ্টেন ইজরা কলিগ। জাতে জেলে, দক্ষ নাবিক, ক্যাপ্টেন উপাধিটা নিজেই নিজের নামের আগে বসিয়ে নিয়েছে।
শুকতারাতেই আছে সে। ক্যাপ্টেন হিসেবে এসেছে, তার জন্যে আলাদা পয়সা দিতে হবে। ষাট ফুটি একটা জাহাজ সামলানো এমনকি মুসার পক্ষেও সবসময় সম্ভব না। তাছাড়া যাচ্ছে ওরা অচেনা সমুদ্রে, দক্ষ একজন নাবিকের দরকার আছে। জাহাজের মাঝি-মাল্লা রয়েছে আরও দুজন, দুজনেই তরুণ। একজনের নাম জামবু, ডাকনাম না ছদ্মনাম কে জানে, আসল নাম বলতে নারাজ। রোদে-পোড়া শরীর, কর্কশ চেহারার মতই যেন চরিত্রটাও। আরেকজন বাদামি চামড়ার এক দানব, নাম কুমালো, বাড়ি দক্ষিণ সাগরের ছোট্ট এক দ্বীপে, রায়াটি। এক বাণিজ্যিক জাহাজের চড়ে এসেছিল আমেরিকায়, স্যান ফ্রান্সিসকোয় নেমেছিল। ঘুরেছে অনেক শহর, স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে, স্বর্গ খুঁজে পায়নি শ্বেতাঙ্গদের দেশে, অথচ গল্প অনেক শুনেছিল। তাই প্রথম সুযোগেই ফিরে চলেছে আবার নিজের দেশে। স্কুনারটা পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দিকে যাবে শুনেই আর দ্বিরুক্তি করেনি, মাল্লার চাকরি নিয়ে উঠে পড়েছে।
সামনের ডেকের নিচে ছোট্ট কেবিনে গাদাগাদি করে ঘুমাতে হবে তিন নাবিককে। তিন গোয়েন্দার থাকার জায়গা আরও কম, পেছনের ডেকের নিচে। জায়গা অনেকই ছিল, ছেড়ে দিতে হয়েছে বিশাল ট্যাংকগুলোর জন্যে, যেগুলোতে, জলজ প্রাণী জিয়ানো হবে। দুটো কেবিনের মাঝামাঝি বসানো হয়েছে ওগুলো।
খুদে গ্যালিটাকে ব্যবহার করা হবে রান্নাঘর হিসেবে। একটা প্রাইমাস স্টোভ আছে। স্টোররূমে আর একরত্তি জায়গা নেই, খাবারের বাক্স, বস্তা, টিনে বোঝাই। আছে মাছ আর অন্যান্য জানোয়ার ধরার নানারকম সরঞ্জাম–জাল, হারপুন, বড়শি, সুতা, আরও অনেক কিছু।
তিনটে মাস্তুলের বড়টাতে, অর্থাৎ প্রধান মাস্তুলের অনেক ওপরে লাগানো রয়েছে একটা মাচামত, ক্রোজ-নেস্ট, কিশোর বলে কাকের বাসা। ওখানে উঠে বসে চোখ রাখা যায় দূরে, শিকার খুঁজে বের করা সহজ হয়। সামনের গলুইয়ে রয়েছে পুলটি– লম্বা একটা তক্তা ঠেলে বেরিয়ে গেছে কয়েক ফুট সামনে, লোহার মোটা পাত দিয়ে ওটাকে জায়গামত ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক ফিশিং বোটেই থাকে ওরকম পুলপিট। হারপুন হাতে ওটার মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় শিকারি, পানিতে মাছের খোঁজ করে। চোখে পড়লেই পলকে ছুঁড়ে মারে হারপুন, গেঁথে তোলে মাছ। ওখানে দাঁড়ালে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়, আশ্চর্য এক ভাল লাগা। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, পায়ের তলায় ছুটন্ত সাগর, মাঝে একটা তক্তা ছাড়া আর কিছু নেই। পানির অনেক নিচে দৃষ্টি যায় এখানে দাঁড়ালে, স্পষ্ট চোখে পড়ে সাগর-জীবন।
পালা করে কয়েকবারই পুলপিটে দাঁড়িয়েছে তিন গোয়েন্দা। অবাক হয়ে ভেবেছে, কি জানি কি চোখে পড়ে যায়? অচেনা কিছু দেখা যেতেই পারে। কারণ প্রফেসর ইস্টউড বলেছেন, প্রশান্ত মহাসাগরে যত প্রাণী আছে, তার অর্ধেকের বেশি হয়ত এখনও অপিরিচিত মানুষের কাছে। মানুষ জানেই না, আছে ওগুলো।
বিশাল এই জলাশয়ের সব চেয়ে বেশি যেখানটায় চওড়া, এগারো হাজার মাইল; গড় গভীরতা তিন মাইল, কোন কোন জায়গা আরও বেশি, ছয়টা গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন একসাথে জোড়া দিয়ে ডোবালেও ডুবে যাবে। লক্ষ লক্ষ দ্বীপ রয়েছে এর বুকে, নামকরণ হয়েছে মাত্র তিন হাজারের। মহাসমুদ্রের এই অসীম জলরাশি কত হাজারো রহস্য এখনও লুকিয়ে রেখেছে বিজ্ঞান আর মানুষের অগোচরে, কে জানে!
হুইল ধরেছে ক্যাপ্টেন ইজরা কলিগ। ছোেট নীল চোখে শেয়ালের ধূর্ততা। রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা মুখের বাদামি চামড়া দেখে আর বোঝার উপায় নেই মূল রঙ কি ছিল। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে বিনাকল-এ রাখা কম্পাসের দিকে।
এই রকম বাতাস থাকলে সহজেই পোনাপের পাশ কাটাতে পারব, একসময় বলল কলিগ।
কেন, বাতাস গোলমাল করার সম্ভাবনা আছে নাকি? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
আছে। একটা অশ্ব অক্ষাংশ। বাতাসের মতিগতি বোঝা মুশকিল। এরকম থাকে না। হাওয়াই ছাড়ানোর পর নিশ্চিন্ত। বাতাস মোটামুটি এক থাকে ওখানে, দুর্ঘটনার ভয় কম।
দুর্ঘটনা? পায়ে পায়ে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে রবিন, কথা শোনার জন্যে। কি দুর্ঘটনা?
হারিক্যান। সর্বনাশ করে ছাড়ে।
এখন কি হারিক্যানের মৌসুম নাকি? মুসা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। থাক, ওসব অলক্ষুণে কথা বলার দরকার নেই। হয়ত কিছুই ঘটবে। কিশোরের মুখের ওপর তীক্ষ্ণ শেয়াল-দৃষ্টি নাচাল কলিগ। এত টাকা খরচ, এত সাজসরঞ্জাম…ওদিকে কি দরকার? শুধুই জানোয়ার ধরা, না অন্য কিছু?
হঠাৎ সন্দেহ হল কিশোরের। তথ্য জানতে চাইছে ক্যাপ্টেন? নাকি জানতে চাওয়ার ভান করছে শুধু, যা জানার জেনে ফেলেছে ইতিমধ্যেই? তাকে তো বলা হয়েছে, জলজ জানোয়ার ধরতে যাচ্ছে ওরা। তাহলে হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? মুক্তা খেতের কথা জানে নাকি লোকটা?