কিশোরের নির্দেশে নোঙর ফেল কুমালো। ভালমত দেখে জায়গা নির্বাচন করেছে গোয়েন্দাপ্রধান। উঁচু হয়ে এখানে উঠে গেছে প্রাচীরের কাঁধ, ফলে ল্যাগুনের উত্তর অংশটা চোখে পড়ে না। ভেসে ভেসে দেয়ালের কয়েক ফুটের মধ্যে চলে এল বোট, তারপর শেকলে টান লেগে আটকে গেল, আর সরতে পারবে না, ঘষাও লাগবে না ধারাল প্রবালের গায়ে।
তীরে নামব আমরা, ভিশনকে বলল কিশোর। আপনি নিশ্চয় নামবেন না। মানুষ নেই। ঈশ্বরের বাণী কাকে শোনাবেন? বোটেই থাকুন। নাকি মাছকে শোনানোর ইচ্ছে আছে?
কিশোরের রসিকতায় হাসল মিশনারি। বলল, না না, আমি থাকি। তোমর যাও। এখানে নেমে কোন লাভ নেই এখন আমার।
তার শেষ কথাটা রহস্যময়। কিশোর বুঝলেও, অন্য তিনজন এর মানে বুঝল না।
বোট থেকে আগে নামল কুমালো। ওখানে পানি এক ফুটেরও কম। ছপা ছপাৎ করে পানি ভেঙে শুকনোয় উঠল ওরা। এগিয়ে চলল উত্তরে। খুব তাড়াতাড়িই বোটটাকে ওদের দৃষ্টির আড়াল করে দিল দেয়াল।
পশ্চিমের দেয়াল ধরে ধরে চলে এল ওরা একটা চওড়া জায়গায়, যেখানে সৃষ্টি হয়েছে দুটো দ্বীপের একটা, ল্যাগুনের উত্তর-পশ্চিম কোণ এটা। তারপর বোতলের গলার মত সরু হয়ে গেছে দেয়ালটা, গিয়ে মিশেছে আরেকটা দ্বীপের সঙ্গে। ওটা উত্তর-পূর্ব কোণে।
ওখানেই কোথাও আছে, কিশোর বলল। প্রফেসর বলেছিলেন দ্বীপের উত্তরপূর্ব কোণে।
দ্বিতীয় দ্বীপটা চওড়ায় কয়েকশো গজ। ঝোপঝাড় ছিল, একসময়, ছিঁড়ে, উপড়ে নিয়ে গেছে ঝড়। পুরো দ্বীপটাই বোধহয় পানির নিচে চলে গিয়েছিল। নারকেলের কাণ্ডগুলো দেখে মনে হয় কবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভ। উপড়ানো কিছু কাণ্ড পড়ে আছে এখনও, তবে বেশিরভাগই ভেসে গেছে।
হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে। দেয়ালের ওপর জমে রয়েছে প্রবালের স্তূপ, কোন কোনটা দশ ফুট উঁচু। হোঁচট খেয়ে পড়লে চিরে ফালাফালা হয়ে যাবে হাঁটু আর হাতের চামড়া, এত ধার ওসব প্রবাল।
দ্বীপের পাশে ল্যাগুনে গভীর একটা খাঁড়ি রয়েছে, তিনদিক থেকে এমনভাবে ঘেরা মনে হয় একটা খুদে উপসাগর। তলা অস্পষ্ট, কারণ পানি ওখানে দশ ফ্যাদমের বেশি। চওড়ায় প্রায় একশো গজ। দেখলেই মনে হয় কি যেন এক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে গভীর এই খড়িটা।
ভাগ্যিস কুমালোকে সঙ্গে এনেছিলাম, মুসা বলল। এত নিচে নামতে পারব আমি। কিশোর, তুমি?
কি যে বল না ছাই। তুমি না পারলে আমি পারব?
নামার জন্যে কাপড় খুলতে গেল কুমালো, তাকে থামাল কিশোর, রাখ, কথা আছে। এই, বস এখানে সবাই।
মিশনারিকে সন্দেহ করছে, একথা সঙ্গীদেরকে জানাল কিশোর।
সন্দেহ আমারও হয়েছে,কুমালো বলল। অনেক মিশনারি দেখেছি আমি। কারও স্বভাবই ওর মত ছিল না। লোকটাকে একটুও পছন্দ হয় না আমার।
আমারও না, রবিন বলল। চল, গিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করি। ৫ লিখুলি জিজ্ঞেস করি, আসলে সে কে?
না, উচিত হবে না, কিশোর বলল। পিস্তল-টিস্তল থাকতে। পরে। থাকুক। আমাদেরকে খুন করার সাহস নিশ্চয় হবে না।
কিছুই বলা যায় না। হয়ত অনেক টাকার মুক্তো রয়েছে এই উপ…হ্যাঁ, উপসাগরই বলি, খাড়ি শুনতে ভাল্লাগে না। লক্ষ, হয়ত কোটি টাকারও হতে পারে। এত টাকার জিনিস পাওয়ার জন্যে খুন করতে দ্বিধা করবে না অনেকেই। আর মনে রেখ, এটা রকি বীচ নয়, পথের মোড়ে মোড়ে পুলিশ নেই। বেআইনী কাজ চলছে কিনা দেখতে আসছে না কেউ। এখানে অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়া সহজ। কাজেই, লোকটাকে খেপানো উচিত হবে না। এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। যেমন ভাবে চলছি আমরা, তেমনি চলব। বুঝতে দেব না যে ওকে সন্দেহ করেছি। এমন কোন আচরণ করবে না, যাতে ব্যাপারটা তার কাছে ফাঁস হয়ে যায়। ঠিক আছে?
মাথা ঝাঁকাল তিনজনেই।
গুড। কুমালো, এবার নামতে পার। দেখা যাক, কি আছে উপসাগরের তলায়।
(দ্বিতীয় খণ্ডে সমাপ্য)