শুনে তো ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে, কিশোর বলল। কিভাবে যেতে হবে? কি কি চিহ্ন দেখে বুঝব ওটা পার্ল ল্যান?
বলছি। এটাই আমার সিক্রেট। চারপাশে চোখ বোলালেন আবার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন কিশোরের দিকে। কেউ শুনে ফেলছে না তো? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, শুনছে!
আমার অবশ্য তা মনে হচ্ছে না, হাসল কিশোর। তবে বলাও যায় না। যেভাবে জিনিসপত্র গাদাগাদি করে রেখেছেন, বাগ লুকানো থাকতেও পারে। খুঁজে বের করা মুশকিল। স্টাফ করা প্রাণীগুলো দেখাল। ওগুলোর কোনটার ভেতরও থাকতে পারে।
কিশোরের হাসিটা ফিরিয়ে দিতে দিতে চেয়ারে হেলান দিলেন প্রফেসর। যাকগে, অত ভেবে লাভ নেই। আমিও বোধহয় বেশি বেশি কল্পনা করছি। ভয় পাচ্ছি। ভয় পাওয়ার কারণও অবশ্য আছে। হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি আসা, রাতে ল্যাবরেটরিতে চোর ঢোকা.হ্যাঁ, কি যেন বললে? বাগ? এক ধরনের প্রেরক যন্ত্র, স্যার। স্পাইরা বলে বাগ।
অ। পুরানো ডিকটোগ্রাফের মত জিনিস। ওকথা আমিও ভেবেছি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি, পাইনি। থাকলে থাকবে, কি আর করা? যা যা বলেছি তোমাদের, সবই হয়ত শুনে ফেলেছে ব্যাটারা। শুনুর্ক। আসল কথাটা আর শুনতে দিচ্ছি না।
প্যাড থেকে একটানে ফড়ৎ করে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে পেন্সিল দিয়ে লিখলেনঃ নর্থ ল্যাটিচিউড ১১.৩৪। ইস্ট লংগিচিউড ১৫৮.১২।
কাগজটা ঠেলে দিলেন ছেলেদের দিকে।
এই প্রথম এটা লেখা হল, বললেন তিনি। এবং আশা করি এই শেষ। মুখস্থ করে নাও। এই অবস্থানে রয়েছে পার্ল ল্যাগুন। কখনও কোন কাগজে লিখবে না, কারও সামনে ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করবে না।
একবার পড়েই মুখস্থ হয়ে গেল কিশোরের, অসাধারণ তার স্মৃতিশক্তি। কয়েক বার পড়ে রবিনেরও মুখস্থ হল। সময় লাগল মুসার। মনে মনে পড়েই চলেছেঃ উত্তরে ল্যাটিচিউড এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট। পূর্বে লংগিচিউড একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট।
মুখস্থ হয়েছে কিনা, জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর। তিনজনেই মাথা ঝাঁকাতে কাগজটা টেনে নিয়ে উল্টোপিঠে একটা নকশা একে বোঝালেন, এই হল ল্যাগুন। এদিকটা উত্তর। এইখানে রয়েছে ঝিনুকের খেত। ল্যাগুনের উত্তর-পূর্ব কোণে পেন্সিলের মাথা রাখলেন তিনি। দেখে নাও ভাল করে।
নকশাটা মনে গেঁথে নিতে লাগল কিশোর।
হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
ম্যাচের কাঠি জ্বেলে কাগজটার এক কোণে আগুন ধরালেন প্রফেসর। পুড়ে ছাই হয়ে গেল পুরোটা কাগজ। সেটা হাতের তালুতে রেখে আঙুল দিয়ে টিপে টিপে মিহি গুঁড়ো করে ফেললেন। তারপর উঠে গিয়ে হাত ধুলেন বেসিনে। ছাইগুলো পানির সঙ্গে মিশে চলে গেল নর্দমায়।
প্রফেসরের বাড়ি থেকে বেরোল তিন গোয়েন্দা। বাইরে ইয়ার্ডের পুরানো ছোট ট্রাক নিয়ে অপেক্ষা করছে বোরিস। ওটাতে করেই এসেছে ছেলেরা।
ট্রাকে ওঠার সময় খেয়াল করল কিশোর, পাশের বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল একজন লোক। তার চেহারা দেখতে পেল না সে। মনে রাখার মত তেমন কোন বিশেষত্বও নেই শরীরের, শুধু পিঠ সামান্য কুঁজো হাঁটার কারণেও এমনটা হতে পারে। সোজা গিয়ে কালো একটা সেডান গাড়িতে উঠল লোকটা।
লোকটাকে লক্ষ্যই করত না কিশোর, যদি না প্রফেসরের সাবধানবাণী মন জুড়ে থাকত তার—ডেনজারাস! তিনবার মরতে মরতে বেঁচেছি…অত্যাচার করে তিলে তিলে মারা হবে তোমাদের-তার মনেও সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছেন প্রফেসর।
সারাটা পথ চুপ করে রইল কিশোর। একটা কথাও বলল না। স্যালভিজ ইয়ার্ডে পৌঁছল ট্রাক। মোড় নিয়ে গেটে ঢুকছে, এই সময় কালো সেডানটা চোখে পড়ল ওর, রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠল সে।
কি হল? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
উ! না, কিছু না, হাসল কিশোর। প্রফেসরের সন্দেহ রোগে আমাকেও ধরেছে। কালো একটা গাড়ি দেখলাম, কিন্তু তাতে কি? প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করল সে। কালো সেডান আমেরিকায় অনেক আছে, রকি বীচেও।
মনকে বোঝানোর চেষ্টা করল বটে গোয়েন্দাপ্রধান, কিন্তু দুশ্চিন্তা দূর করতে পারল না। হয়ত ওদেরকে প্রফেসরের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে চোরদের কেউ, বেরোতে দেখেছে। ঘরে বাগ লুকিয়ে রেখে তাদের কথাও শুনেছে। আর তা হয়ে থাকলে, প্রফেসরের শত্রু এখন ওদেরও শত্রু হয়ে গেল। কালো গাড়িতে করে ট্রাকের পিছু পিছু এসে জেনে গেল, ওরা কোথায় থাকে।
এরপর কি করবে লোকটা? হয়ত…
দূর! কি আবোল-তাবল ভাবছে? এত হয়ত হয়ত করছে কেন? নিজেকে ধমক লাগাল কিশোর। মন থেকে সমস্ত সন্দেহ আর দুশ্চিন্তা ঝেড়ে বিদেয় করার চেষ্টা করল।
৩
রাজহংসীর মত ভেসে চলেছে মর্নিং স্টার কিশোর বাংলা নাম রেখেছে শুকতারা। ঘোষণা করে দিয়েছে, যতদিন স্কুনারটা তাদের অধিকারে থাকবে, শুকতারা বলেই ডাকবে ওটাকে। রবিন আর মুসা আপত্তি করেনি। ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ গাঁইগুই করে শেষে মেনে নিয়েছে। কিশোর বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে, যেহেতু.জাহাজটা ভাড়া নিয়েছে ওরা, ওটার ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব এখন ওদের।
দুরন্ত গতিতে ছোটার জন্যেই যেন জন্ম হয়েছিল জাহাজটার। সমকক্ষ টিউনা শিকারি আর কোন জাহাজই পারে না শুকতারার সঙ্গে, মাছ নিয়ে বন্দরে ফেরার প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। তিনকোনা মারকোনি পালের কারণেই গতি এত বেড়েছে এটার। এ ধরনের পাল কুনারে সাধারণত দেখা যায় না, সম্রান্ত রেসিং ইয়টগুলোতেই লাগানো হয়। কিন্তু শুকতারা সাধারণ স্কুনার নয়। বোট রেসেও অংশগ্রহণ করেছে। তিনটে পাল ছাড়াও রয়েছে অকজিলারি ইঞ্জিন, বাতাস পড়ে গেল, কিংবা সরু চ্যানেলের ভেতর দিয়ে চলার সময় ওই ইঞ্জিন ব্যবহার হয়সাধারণত পাল যেখানে কাজ করে না। কিন্তু বাতাস থাকলে, আর তিনটে পালেই হাওয়া লাগলে যে গতি পায়, ইঞ্জিনের পুরো ক্ষমতা নিংড়েও তার অর্ধেক হবে না। এই তো এখনই সতেরো নট গতিতে ছুটছে, অথচ যেন গায়েই লাগছে না ওর।