বিকেলে আরেকটা দ্বীপ দেখা গেল। মিশনারি যখন শুনল, কিশোররা এখানেও থামবে না, নামতে রাজি হল না সে। আরও সামনে যেতে চায়।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল কিশোর, পোনাপে থেকে যতই দূরে সরে আসছে, চার্ট ততই গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই মিলছে না। কোন কোন দ্বীপের চিহ্নের পাশে লেখা রয়েছে পি. ডি. অর্থাৎ, পজিশন ডাউটফুল (অবস্থান সন্দেহজনক)। খুদে খুদে অনেক দ্বীপ দেখা গেল, যেগুলো দেখানই হয়নি চার্টে। কিংবা চার্টে আছে, এমন অনেক দ্বীপ খুঁজে পাওয়া গেল না। বোঝা গেল, অনেকটা আন্দাজের ওপরই তৈরি হয়েছে চার্টটা। যে করেছে তার কাছেও প্রশান্ত মহাসাগরের এই অচেনা অঞ্চল অচেনাই থেকে গেছে। এ-যেন এক হারানো পৃথিবী।
নানারকম সমস্যায় না ভুগলে এখানে কিছুদিনের জন্যে হারিয়ে যেতে আপত্তি ছিল না কিশোরের। তার মাথা জুড়ে রয়েছে এখন জটিল সব অঙ্ক। মিশনারির ভয়ে কাগজ-কলমের সাহায্য নিতে পারছে না। একটু ভুলচুক হয়ে গেলে কি সর্বনাশ হয়ে যাবে আন্দাজ করতে পারছে। কঠিন হিসেব আর জ্যামিতির বোঝায় এখন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে তার মগজ। এইভাবে মনে মনে হিসেব করে কতটা কি করতে পারবে? ভুল ইতিমধ্যেই হয়ে যায়নি তো? পারবে ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে? তার মনে হল, পারলে, সেটা অলৌকিক ব্যাপার হয়ে যাবে।
সারাক্ষণ মনে বাজছে একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট পুব, এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট উত্তর। তার ভয় হচ্ছে, ঘুমের ঘোরে না জোরে জোরে বলে ফেলে। মাত্র চারফুট দূরে বাংকে ঘুমায় ভিশন। তার কানে কথাগুলো চলে যাবেই। তাহলেই সব শেষ, এত কষ্টের কোন মানে থাকবে না আর।
উজ্জ্বল তারার আলোয় আরেকটা রাত বোট চালানো হল। পরদিন সকালে সূর্য উঠল। হুইল ধরে আছে মুসা। গলুইয়ের কাছ থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, রবিন, ডাঙাআ, ডাঙা দেখা যাচ্ছে!
হয়েছে,কেবিনে থেকে ভাবল কিশোর। দেখে ফেলেছে! তাড়াতাড়ি বাংক থেকে নেমে ডেকে বেরিয়ে এল সে। তার পিছে পিছেই বেরোল মিশনারি।
সামনে, সাগরের মাঝে যেন শুয়ে রয়েছে প্রবাল প্রাচীরের একটা আঙটি। একটা সবুজ ল্যাগুনকে ঘিরে রেখেছে। দুটো জায়গায় চওড়া হয়ে গিয়ে বীপ সৃষ্টি করেছে প্রাচীরটা, তবে ওগুলোতে উদ্ভিদ প্রায় নেই। ছিল, এখন নেই। এরকম দৃশ্য আসার সময় আরও কয়েকটা দ্বীপে দেখে এসেছে ওরা। এর জন্যে দায়ী হারিক্যান। নষ্ট করে দিয়েছে সব। আর এই দ্বীপ দুটোকে যেন একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে নারকেল গাছের মাথা, গোড়া থেকে আটদশ ফুট উঁচু কাণ্ডগুলো শুধু রেখে গেছে।
উত্তেজনায় কাঁপছে কিশোরের বুক। ঠিক জায়গাতেই এসেছে? ভুল করেনি তো? যন্ত্রপাতি নিয়ে বসল। ভালমত দেখেটেখে হিসেব বের করল। না, ঠিকই তো আছে। মগজে যা লেখা হয়ে আছে সেই একই রীডিং, একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট পুব, এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট উত্তর।
তাহলে এটাই সেই পার্ল ল্যাগুন! মুক্তাদ্বীপ!
নব্বই মিনিট করে বাদ দিয়ে লগবুকে রীডিং লিখল সে: পার্ল ল্যান পাওয়া গেল। একশো ছাপ্পান্ন ডিগ্রি বেয়াল্লিশ মিনিট পুব, দশ ডিগ্রি চার মিনিট উত্তর।
যাও ব্যাটা, এবার লিখে নাও গিয়ে কাগজে, মনে মনে হাসল কিশোর। আবার যদি আস, দেখবে দ্বীপটা নেই। কিংবা যদি কোনটা থাকেও সেটা এই দ্বীপ নয়। পশ্চিমে সরবে নব্বই মাইল, দক্ষিণেও সরবে নব্বই মাইল। তুমি তো তুমি, ব্যাটা, দুনিয়ার অভিজ্ঞতম নাবিকও এই রীডিং দিয়ে পার্ল ল্যাণ্ডন খুঁজে বের করতে পারবে না।
ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল কিশোর, ভিশন যে নাবিক নয় এই জন্যে। ডেকের ওপরে চলাফেরার ভঙ্গিই বুঝিয়ে দেয় লোকটা জাহাজী নয়। সাগরে বড় ঢেউ উঠলে, জাহাজ বেশি দুললে ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যায় তার। ইঞ্জিন চালাতে আর হুইল ধরতে পারে বটে, কয়েকবার দেখলে আনাড়ি লোকও সেটা পারবে। এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। সেক্সট্যান্ট বোজার চেষ্টা করেছিল একবার, উল্টো করে ধরেছিল যন্ত্রটাকে, দেখেছে কিশোর। নটিক্যাল অ্যালমানাকে হাত দেয়নি একবারও। পুরোপুরি নির্ভর করে বসে আছে কিশোরের করা হিসেবের ওপর।
যাও, ভালমত দেখে নাও পার্ল ল্যাগুন, মনে মনে ভিশনকে বলল কিশোর। জীবনে আর দেখার সুযোগ তো পাবে না।
ল্যাগুনটাকে চক্কর দাও, হুইল ধরে থাকা মুসাকে বলল কিশোর। দেয়ালের বেশি কাছে যেয়ো না।
মাইলখানেকের বেশি হবে অ্যাটটার বেড়। পশ্চিম দিক দিয়ে ল্যাগুনে ঢোকার বেশ সুন্দর একটা পথ আছে। পুরো এক চক্কর ঘুরে এসে ওখান দিয়ে ঢুকতে শুরু করল মুসা। বেশ কায়দা করে ঢেউয়ের মাথায় চড়ে চড়ে বোটটাকে ঢুকিয়ে ফেলল ভেতরে। ওখানটায় পানি খুব কম। ছয় থেকে বারো ফুটের মধ্যে। পরিষ্কার সবুজ পানির ভেতর দিয়ে তলা দেখা যাচ্ছে। প্রবালের স্বর্গ যেন জায়গাটা। রামধনুর সাত রঙ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের নানা আকারের প্রবাল-দুর্গ।
পানির নিচে পরীর রাজ্য, প্রাচীরের ওপরে হারিক্যানের ধ্বংসলীলা, একটার সঙ্গে আরেকটার কোন মিল নেই। বড় বেশি চোখে বাজে। খুদে দ্বীপ দুটোর দিকে তাকালেই একটা ধাক্কা খেতে হয়।
খাইছে! এখানে আটকা পড়তে চাই না আমি কিছুতেই! গায়ে কাঁটা দিল মুসার। তুফানে করেছে কি দৈখ! আমার তো মনে হয় ইঁদুরও বাঁচেনি। পার্ল ল্যাগুন, না? মুক্তাদ্বীপ? তার চেয়ে বল মৃত্যু দ্বীপ কিংবা ক্ষুধার দ্বীপ।