কিছুক্ষণ পর লগবুকটা নিতে কেবিনে এল কিশোর। দেখে, বইটা খুলে তার ওপর ঝুঁকে রয়েছে মিশনারি। রীডিং টুকে নিচ্ছে একটা কাগজে।
এদিকে পেছন করে আছে লোকটা। পিঠটা বেঁকে রয়েছে, যেন একটা পিপা। হঠাৎ টের পেল, ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। তাড়াতাড়ি পিঠটাকে আরও কুঁজো করে আড়াল করতে চাইল তার কাজ, কাগজের টুকরোটা রেখে দিল পকেটে।
ফিরে চেয়ে হাসল লোকুটা। লগবুকটা দেখছিলাম। ভারি ইনটারেসটিং। না বলেই হাত দিলাম, কিছু মনে করেছ?
না না, মনে করার কি আছে, বলল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে বাঁকা পিঠটার দিকে। কি যেন লুকিয়ে রেখেছে ওই কুঁজ! কোথায় দেখেছে ওই পিঠ?
মনে পড়ল। ঠিক এই রকম একটা পিঠ দেখেছে, প্রফেসরের বাড়ি থেকে সেদিন বেরিয়ে আসার সময়। কালো গাড়িতে চড়েছিল যে লোকটা। তারপর ট্রাকের পিছে পিছে আসতে দেখেছে, লোকটাকে স্পষ্ট দেখেনি, তবে গাড়িটা দেখেছে।
এরকম কুঁজ আরও মানুষের থাকতে পারে। শুধু এই একটা কারণ নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নেই, করতও না কিশোর, কাকতলীয় বলেই ধরে নিত। কিন্তু চুরি করে লগবুকের রীডিং দেখা, নকল করা, কাগজের টুকরো লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা, সন্দেহ বাড়িয়ে দিল তার। প্রফেসরের ভয় ছিল তাঁর ঘরে বাগ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের কথা কেউ আড়িপেতে শুনে ফেলছে। আশঙ্কা অমূলক ছিল না তার। সত্যি শুনেছে। সব শুনেছে, শুধু জানতে পারেনি মুক্তাদ্বীপের অবস্থান। তার পর সেই লোক, কিংবা তার কোন সহকারী মিশনারির ছদ্মবেশে উড়ে এসেছে পোনাপেতে। চালাকি করে উঠে পড়েছে বোটে, তাদের সঙ্গে চলেছে এখন। লগ দেখে জেনে নেবে, দ্বীপটা কোথায়। তারপর যখন খুশি চলে আসতে পারবে এখানে।
ডেকে ফিরে এল কিশোর। মুসাকে সরিয়ে দিয়ে হুইল ধরল। এত সহজে মিশনারির ফাঁদে পড়ল বলে লাথি মারতে ইচ্ছে করছে নিজেকে। মিশনারি! নেটিভদের সাহায্য করতে যাচ্ছে! শয়তান কোথাকার! ভুল যা করার তো করে ফেলেছে, এখন এটাকে শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে।
বুঝতে পারছে, পাকা অপরাধীর কবলে পড়েছে। বলা যায় না, স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে খুন করতেও হয়ত দ্বিধা করবে না লোকটা। এসেছে যখন, মুক্তাদ্বীপের
অবস্থান জানার চেষ্টা করবেই, যেভাবেই হোক।
কি হয়েছে, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করল। ঘামছ কেন? গরম তো তেমন নেই।
ঠাণ্ডা রয়েছে রবিন আর মুসা, ঠাণ্ডাই থাক, ভাবল কিশোর। এখন সব বলে ওদেরকেও দুশ্চিন্তায় ফেলে লাভ নেই। এমনও হতে পারে; মিশনারি সত্যি মিশনারি। কৌতূহলের বশেই দেখেছে লগবুকটা।
যদিও সেটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে জানাজানি হয়ে গেলে আরও খারাপ হবে। লোকটা যদি বুঝে ফেলে তাকে সন্দেহ করা হয়েছে, তাহলে আরও সতর্ক হয়ে যাবে। হয়ত নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চূড়ান্ত কিছু করে বসবে। তাতে ক্ষতি ছাড়া ভাল হবে না। তার চেয়ে বরং ওকে ভাবতে দেয়া উচিত, তার কাজ পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছে। কুমালো, মুসা আর রবিনকে জানালে ওরা কিশোরের মত শান্ত থাকতে পারবে না। এমন কিছু করে বসবে, যাতে মিশনারি টের পেয়ে যাবে, তার ছদ্মবেশ ফাঁস হয়ে গেছে।
আমাকেই ওর ওপর চোখ রাখতে হবে, ভাবল কিশোর। কিছুতেই ভাবতে দেয়া চলবে না যে আমি ওকে সন্দেহ করেছি। আর ওকে ফাঁকি দেয়ার একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
ঘন্টার পর ঘন্টা সমস্যাটা নিয়ে ভাবল আর ঘামল কিশোর। তারপর, পরের নতুন রীডিংটা ঠিক করার আগেই চট করে সমাধানটা এসে গেল মাথায়।
বোটের পজিশন ঠিক করল একরকম, লগে লিখল আরেক রকম। দশ মিনিট করে বাদ দিয়ে দিল।
পরের বার রীডিং ঠিক করার সময় বাদ দিল বিশ মিনিট, তার পরের বার তিদিশ মিনিট, এবং তার পরের বার চল্লিশ মিনিট। এভাবেই বাদ দিতে থাকল, যতবার পজিশন ঠিক করল নতুন করে। লগবুকে বাড়তেই থাকল ভুলের মাত্রা। কিন্তু কিশোরের জানা আছে, কতটা বাদ দিয়েছে, কাজেই সঠিক পথ নির্ণয় করতে তার কোন অসুবিধে হল না।
কেবিনেই ফেলে রাখল লগবুক। দেখে দেখে রীডিং নকল করার প্রচুর সুযোগ এবং সময় দিল ভিশনকে।
এক মিনিট ল্যাটিচিউড সমান এক সামুদ্রিক মাইল ধরা হয়। দশ মিনিট মানে দশ মাইল। কিশোর যতটা সরিয়েছে, তাতে করে আবার এসে ওই রীডিং দিয়ে দ্বীপটা কিছুতেই খুঁজে পাবে না মিশনারি।
লোকটা যদি মুক্তাচোরই হয়ে থাকে, কোন সন্দেহ নেই, ফিরে গিয়ে মুক্তা তোলার জন্যে বড়সড় জাহাজ আর ডুবুরি নিয়ে ফিরে আসবে। তখন যেন কিছুতেই দ্বীপটা খুঁজে না পায়, সেই ব্যবস্থাই করেছে কিশোর। আসল রীডিং দিয়েই দ্বীপটা খুঁজে পাওয়া কঠিন, আর এত বড় ভুল দিয়ে তো অসম্ভব।
পরদিন দিগন্তে কয়েকটা নারকেল গাছের মাথা চোখে পড়ল। ধীরে ধীরে ফুটে উঠল একটা দ্বীপের অবয়ব। কিশোর জানে, ওটা মুক্তাদ্বীপ নয়। কাজেই শান্ত রইল সে। কিন্তু বড় বড় হয়ে উঠল নকল মিশনারির চোখ।
এখানেই নামবে? জিজ্ঞেস করল মিশনারি।
না, কিশোর বলল। আপনি নামবেন নিশ্চয়? অনেক নৌকা দেখছি। নিশ্চয় অনেক মানুষ আছে এখানে, ঈশ্বরের বাণী শোনাতে পারবেন।
কিন্তু আগ্রহী হল না মিশনারি। বলল, না, আরও সামনে যেতে চাই। পোনাপে থেকে এ-জায়গা বেশি দূরে নয়, হয়ত ওখানকার মিশনারিরাই চলে আসে এখানে। আমি যেতে চাই এমন জায়গায়, সভ্য মানুষের নামও শোনেনি যারা।