দ্বীপের মানুষগুলোর জন্যে দুঃখ হল কিশোরের। ওদের জন্যে কিছু করতে ইচ্ছে হল। কিন্তু কি করতে পারবে সে? কি ক্ষমতা আছে? আছে, অতি সামান্য হলেও আছে, পরোক্ষভাবে। মিশনারি ভদ্রলোককে তার বোটে যাত্রী হিসেরে নিতে পারে, নামিয়ে দিতে পারে তিনি যে দ্বীপে নামতে চান। মনস্থির করে ফেলল গোয়েন্দাপ্রধান, সঙ্গে নেবে পাদ্রী সাহেবকে।
১২
অনেক পেছনে পড়ে থাকল পোনাপে। মেঘে ঘেরা উঁচু টটলম চুড়াটাও চোখে পড়ছে না আর এখন।
যেদিকেই তাকানো যায়, আকাশ নীল। সাগর শান্ত। ভাল এগোচ্ছে মোটরবোট। আশেপাশে খেলে বেড়াচ্ছে ডলফিন। উড়ুক্কু মাছের ছড়ানো ডানায় রোদের চমক।
এই বোটটার নাম রেখেছে কিশোর মেঘনা। আগে জাপানী নাম ছিল কিকু, জাপানী এই শব্দটার মানে ক্রিসেনথিমাম। কেনার পর নামটা বদলে ফেলেছে সে।
জন্মের সময় নিশ্চয় ফুলের মতই সুন্দর ছিল বোটটা, এখনও তার কিছুটা অবশিষ্ট রয়েছে। তবে নতুনের সেই সুগন্ধ আর নেই। এখন আছে বোঁটকা গন্ধ, সামুদ্রিক মাছের তীব্র আঁশটে গন্ধ যা কখনও কোন কিছুতেই দূর হবার নয়। এর ডেক আর কিনারে অসংখ্য বোনিটোর কাটার দাগ। আর রয়েছে তলোয়ার মাছের তলোয়ার, ব্যারাকুড়ার দাঁত আর হাঙরের সিরিশ কাগজের মত খসখসে চামড়ার স্বাক্ষর।
বোটের সবাই সুখী। গ্যালিতে দাঁড়িয়ে পলিনেশিয়ান গানের সুর গুন গুন করছে কুমালো। গলুইয়ের কাছে খালি হাতে উড়ুক্কু মাছ ধরার চেষ্টা করছে মুসা। রেলিঙের কাছে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে সাগর দেখছে রনি- নই ধরেছে কিশোর। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের কড়া রোদ অনেকখানি মোলায়েম হয়েছে। সাগরের শীতল বাতাসের পরশে।
বোটে সব চেয়ে সুখী ব্যক্তি এখন রেবারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন। কোন কারণ ছাড়াই একটু পর পর হেসে উঠছেন দরাজ গলায়।
ভালই আছেন, স্যার, আপনি, কিশোর বলল। চিন্তা নাই ভাবনা নাই…
কি সাংঘাতিক এক রসিকতা যেন করে ফেলেছে কিশোর। হাসতে আরম্ভ করল মিশনারি। হাসতে হাসতে পানি চলে এল চোখে। হাসব না…হাসব না বলছ…কল্পনা করতে পার? যেখানে যেতে চাই ঠিক সেখানে নিয়ে চলেছ… থেমে গেল সময়মত। তোমার জন্যেই পারলাম…
না না, এ-আর এমন কি? বাধা দিয়ে বলল কিশোর।
এমন কি মানে! তুমি বুঝতে পারছ না ইয়াং ম্যান, আমার জন্যে এটা কতখানি। কোন ধারণাই নেই তোমার, হাহ, হাহ। অবশেষে যাচ্ছি সেখানে, বাদামি ভেড়াদের এলাকায়…খুশি হব না? এর চেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার আছে ঈশ্বরের কাছে?
লোকটার কথাবার্তা অদ্ভুত লাগল কিশোরের। কোথায় যেন একটা অমিল রয়ে গেছে! পাদ্রীর হাসিটাও যেন কেমন! ভাল লাগে না।
না লাগুক। ভাবনাটা দূর করে দিতে চাইল কিশোর। সবার হাসিই যে সবার ভাল লাগতে হবে এমন কোন কথা নেই।
পাদ্রী সাহেব কি করে-হাসেন, কথা বলেন, সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই তার। ওর কাজ, তাঁকে এমন কোন দ্বীপে নামিয়ে দেয়া, যেখানে তিনি দ্বীপবাসীদের সাহায্য করতে পারবেন। চার্টে দেখা যাচ্ছে ওরকম দুটো দ্বীপ, পার্ল ল্যাগুনে যাবার পথেই পড়ে।
দুপুর। চারপাশে ফথাও ডাঙার চিহ্ন চোখে পড়ছে না। পাল নেই, জাহাজ নেই, এমনকি স্টীমারের ধোঁয়াও নেই কোনখানে। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। সূর্য ঠিক মাথার ওপরে। কোন দিক থেকে এসেছে ওরা, কোন দিকে চলেছে, কিছুই বোেঝার উপায় নেই এখন কম্পাস ছাড়া।
ভোমার হিসেবে ভূল না হলেই বাঁচি, কিশোরকে বলল মুসা। একটু এদিক
ওদিক হলেই এখন সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।
সেটা কিশোরও বুঝতে পারছে। সেক্সট্যান্ট আর ক্রোনোমিটার বের করল। লগবুকের রীডিং দেখল, উত্তর-পশ্চিমে চলেছে। এখন যেভাবে চলেছে, সেরকম চলতে পারলে সহজেই পার্ল ল্যাগুনে পৌঁছানো যাবে।
কিন্তু কিশোর জানে, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। পথভ্রষ্ট করে দিতে পারে বাতাস। তাছাড়া উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের কাছাকাছি হচ্ছে এখন ওরা। আগে থেকে বোঝার উপায় নেই ওই স্রোতের শক্তি কতখানি। কোন দিকে যে বইছে, সেটাও
সঠিক বলা যায় না। মোটামুটি জানা আছে, ঝোঁকটা পশ্চিমমুখী।
বিশাল এই জলরাশির মাঝে খুদে একটা দ্বীপ খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার চেয়েও কঠিন মনে হচ্ছে এখন কিশোরের কাছে। মহাসাগর আর আকাশের অসীমতার মাঝে নিজেদেরকে বড় ক্ষুদ্র আর নগণ্য লাগছে। চার্ট বলছে, পানির গভীরতা ওখানে তিন মাইল। সাগরের তলায় ওখানে রয়েছে অসংখ্য ডুবো-পাহাড় আর উপত্যকা।
লগবুক দেখে বারবার হিসেব মিলাল কিশোর। দেখল, কোথাও ভুল হল কিনা।
রাতের বেলা সেদিন ভালই থাকল আবহাওয়া। আকাশ পরিষ্কার। তারা দেখা যায়, কাজেই যাত্রাপথ ঠিক করতে অসুবিধে হল না। কিশোর, মুসা আর কুমালো পালা করে হুইল ধরছে। রবিন বোট চালাতে জানে না, কাজেই তার হাতে হুইল ছাড়তে ভরসা পেল না কেউ। অনেকক্ষণ ডেকে বসে থেকে, গল্প করে মাঝরাতের দিকে ঘুমাতে গেল সে। মিশনারি বলল, নৌ-বিদ্যার কিছুই জানে না। বসে থেকে আর কি করবে? সারাটা রাত কেবিনের বাংকে কাটাল সে।
পরদিন সূর্য ওঠার পর কিছুটা অশান্ত হল সাগর। বোটও স্থির থাকতে পারল স্বাভাবিকভাবেই, দুলছে, গড়াচ্ছে। নাস্তা তেরি করে আনল কুমালো। ডেকে খেতে বসল সবাই। মিস্টার ভিশন জানাল, শরীর খারাপ লাগছে তার, সীসিকনেস। কাজেই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে আবার গিয়ে ঢুকল কেবিনে।