কালো হয়ে গেল ডেংগুর মুখ। হাত চলে গেল রিভলভারের বাটে। কিন্তু বের করতে গিয়েও করল না। দ্রুত ভাবনা চলেছে মাথায়। জামবু ঠিকই বলেছে, তার সমস্ত জারিজুরি খতম করে দিতে পারে। ওকে থামাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? এই দিনের বেলা খুন্ন করা চলবে না। গুলির শব্দ অনেকের কানে যাবে এখানে গুলি করলে। টাকা দিয়ে দেবে? তাহলেও শয়তানটার মুখ বন্ধ করা যাবে কিনা সন্দেহ। আরও টাকার জন্যে চাপ দেবে, শুরু করবে ব্ল্যাকমেইল। না, অন্য কোন ভাল ব্যবস্থা করতে হবে।
চেহারাটা স্বাভাবিক রাখল ডেংগু। শোনো, এদিকে এস। বুঝতে পেরেছি, দুর্ব্যবহার করে ফেলেছি তোমার সঙ্গে। তোমার সাধ্যমত করেছ, ছেলেগুলো মুখ না খুললে তুমি কি করবে? এরচে বেশি অন্য কেউ হলেও করতে পারত না। ঠিক আছে, টাকা আমি তোমাকে দেব। গলাটা শুকিয়ে গেছে। চল, কোথাও বসে ভিজিয়ে নেয়া যাক।
ডেংগুর এই হঠাৎ পবিবর্তনে সন্দেহ হল জামবুর। কিন্তু টাকা আর মদের লোভও সামলাতে পারল না। লোকটার সঙ্গে চলল সে।
আবার মেইন স্ট্রীটে ফিরে এল ওরা। টিলাটার দিকে এগোচ্ছে ডেংগু, যেটাতে ছেলেরা উঠেছে। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জামবু।
কিন্তু বাংলো পর্যন্ত গেল না ডেংগু। তার আগেই রাস্তা পেরিয়ে ছোট একটা লিকার শপের দিকে এগোল।
একটা গাছের নিচে জটলা করছে কয়েকজন পোনাপিয়ান জেলে, মাছ ধরে ক্লান্ত হয়ে এখন বিশ্রাম নিতে এসেছে। তাদের ঠেলে সরিয়ে দোকানের দরজার দিকে এগোল ডেংগু। জামবুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। রোগাটে একজন শ্বেতাঙ্গ বসে আছে কাউন্টারের ওপাশে।
তাকে বলল ডেংগু, বিল, ও আমার বন্ধু, জামরুকে দেখাল সে। এইমাত্র এল। গলা ভেজানো দরকার। বেশি করে দিতে হবে।
নিশ্চয়, বিল বলল। হতচ্ছাড়া এই দেশে তো কেউ আসে না। বন্ধু এসেছে, তোমার কেমন খুশি লাগছে, বুঝতেই পারছি। দেব, যত চাও।
আনন্দ করতে চাই আজ, জানালার বাইরে তাকাল ডেংগু। মন খুলে। আর পার্টি ছাড়া আনন্দ হয় না। লোক আর পাব কোথায়? জামবু, ওই ব্যাটাদেরই গিয়ে ডেকে আনে।
না না, ওদের নয়, তাড়াতাড়ি বাধা দিল বিল। বাদামিদের মদ খাওয়া এখানে বেআইনী।
আরে রাখ তোমার আইন! পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করে বিলের নাকের কাছে নাড়ল। এই যে আইন। জামবু, যাও, ডেকে আনো।
কানাকাগুলোকে মদ খাওয়ানোর কোন ইচ্ছেই নেই জামবুর। কিন্তু ডেংগুর যদি পয়সা বেশি হয়ে যায় তার কি? দরজায় বেরিয়ে হাত তুলে ডাকল লোকগুলোকে। অদৃশ্য গেলাস ঠোঁটের কাছে নিয়ে মদ খাওয়ার ভঙ্গি করল।
একবারই যথেষ্ট। হুল্লোড় করে ছুটে এল জেলেরা।
মদ তো নয়, পোনাপিয়ানদের জন্যে ডিনামাইট। ওসব ছাড়াই ওদের শান্ত রাখা মুশকিল, যোদ্ধার রক্ত ওদের শরীরে, পূর্বপুরুষেরা ছিল দারুণ লডুয়ে, কথায় কথায় লেগে যেত। মদ পেটে পড়লে যেন উন্মাদ হয়ে যায়। এই জন্যেই ওদের কাছে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
একটা কাজ করতে পারি আমি, বিল বলল। মদ তোমার কাছে বিক্রি করব। তোমার জিনিস তুমি কাকে দেবে, সেটা তোমার ব্যাপার।
ঠিক আছে। খুব কড়া দেখে দাও।…জামবু, এই নাও টাকা, বিশ ডলার তার হাতে গুঁজে দিল ডেংগু। যত খুশি মদ কিনে খাওয়াও বন্ধুদের। টাকা লাগে আরও দেব।
টাকাটা বিলকে দিল জামবু।
ও-কে। এই রসিদটা সই কতো, মেমোবুকটা ঠেলে দিল বিল।
কেন?
নিয়ম। এখানে মদ কিনলে সই করতে হয়। কার কাছে বিক্রি করলাম পুলিশ জানতে চাইবে।
মদ খাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে গেছে জামবু। কিছুই না ভেবে সই করে দিল।
ফিরে চেয়ে দেখল, ডেংগু নেই, কোন্ ফাঁকে চলে গেছে।
ঘন্টা দুয়েক পর তুমুল হই-হট্টগোল কানে এল তিন গোয়েন্দার। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখায় ব্যাঘাত ঘটল ওদের।
ক্যাপ্টেন কলিগ জাহাজে ফিরে গেছে। কুমালো রান্নাঘরে ব্যস্ত।
কুমালো, ডেকে বলল কিশোর। বাইরে গিয়ে দেখ তো কি হয়েছে।
বেরিয়ে গেল কুমালো। খানিক পরেই হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল। দাঙ্গা লেগেছে…-জামবুকে পুলিসে ধরেছে…।
হুড়াহুড়ি করে রাস্তায় বেরোল তিন গোয়েন্দা।
এদিক ওদিক দৌড় দিয়েছে জনাবারো পোনাপিয়ান, মাতাল বোঝাই যায়। ছুরি মারামারি করেছে দুজনে, শরীর জখম, রক্ত ঝরছে। রাস্তার অনেক নিচে জামবুকে ধরেছে দুজন নেভাল পুলিশ।
পথের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা এক লোক, পিঠ সামান্য কুঁজো। হাতে কাল একটা বই।
ছেলেরা এগোল। তাদেরকে দেখে এগিয়ে এল লোকটা। দুর্ভাগ্য, বলল সে। ভারি দুর্ভাগ্য ওদের। করুণার দৃষ্টিতে তাকাল মাতালগুলোর দিকে।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওই জাহাজীটা মদ খাইয়েছে ওদের। বেআইনী, ভীষণ বেআইনী! ঈশ্বর তো নিষিদ্ধ করেছেনই, মানুষও করেছে এখানে। বাইরে থেকে আসে শয়তান, এখানকার নিস্পাপ সরল লোকগুলোর সর্বনাশ করে।
জামবুর দিকে তাকাল কিশোর। পুলিশে খবর দিল কে?
আমি দিয়েছি। এখানকার নাগরিক এবং মিশনারি হিসেবে এটাকে আমার কর্তব্য মনে করেছি।
কিশোর লক্ষ্য করল, লোকটার হাতের ছোট বইটা বাইবেল। ভাবল, পোনাপিয়ানদের সৌভাগ্য, এরকম একজন মানুষ পেয়েছে তাদের মাঝে।
কি শাস্তি হবে?
বেশি না, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মিশনারি। এই বড় জোর মাস দুই জেল। তারপর বের করে দেবে দ্বীপ থেকে। দেশে পাঠিয়ে দেবে।
জামবুর জন্যে সুপারিশ করতে যাবে কিনা ভাবল কিশোর। শেষে ভাবল, থাক, এই ভাল হয়েছে। শয়তানির শাস্তি হয়েছে, তার পথের কাঁটাও দূর হয়েছে। জাহাজে তুললে আবার লাগত ওর বিরুদ্ধে, প্রফেসরের গোপন দ্বীপের খবর জানার চেষ্টা চালাত। আরও কি কি করত কে জানে! জেনেশুনে বিপদ সঙ্গে নেয়ার কোন মানে হয় না। জেলে আটকে থাকলে তার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সৌভাগ্যই বলতে হবে।