পা দিয়ে ঠেলে, প্রায় লাথি মেরেই বাচ্চাটাকে পাশের ঝোপে ফেলে দিল লোকটা। চিৎকার করে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।
অস্বস্তি বোধ করছে জামবু। লোকটা ভীষণ বদমেজাজী। ভয়ই পাচ্ছে এখন। যা বলতে এসেছে, সেটা শুনে মোটেই খুশি হবে না ও। কারণ খুশি করার মত কোন তথ্য জানতে পারেনি সে।
ইউরোপিয়ান স্টাইলে তৈরি একটা বাড়ির বাগানে ঢুকল ওরা। লেবু, কমলা, ডালিম, ম্যাংগোস্টীন আর পিকক পাম নামে একজাতের তাল জাতীয় গাছ প্রচুর জন্মে আছে।
ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলল লোকটা। জামবুকে নিয়ে এল একটা ঘরে। ছাতা পড়া দেয়াল। তাড়াহুড়ো করে এসে ঢুকল দুজন পোনাপিয়ান চাকর। চেয়ার সাজিয়ে দিল মেয়েটা। পুরুষটা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, প্রভু কি খেতে ইচ্ছে করেন।
বেরো এখান থেকে! গর্জে উঠল লোকটা। দুজনেই যা! বলেই ঘাড় ধরে ধাক্কা মারল মেয়েটাকে। হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল সে তার সঙ্গীর, পিঠে। পেছন ফিরেও তাকাল না আর ওরা। দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল লোকটা।
নোঙরা ছুঁচোর দল! খেপা কুকুরের মত দাঁত খিচাল সে। বাদামী চামড়ার নিকুচি করি! আমাকে দায়িত্ব দিলে কবে দ্বীপ থেকে ঝেটিয়ে খেদাতাম ব্যাটাদের!
একটা চেয়ারে জামুবকে বসার ইঙ্গিত করে তার মুখখামুখি আরেক চেয়ারে। বসল লোকটা। সামনে ঝুঁকল। দুজনের চোখের দূরত্ব এখন মাত্র দুই ফুট। তার বাঁকা পিঠ দেখে মনে হয়, শিকারের ওপর ঝাঁপ দিতে তৈরি হচ্ছে সিংহ।
অল রাইট। বলে ফেলো এবার! ঘেঁকিয়ে উঠল লোকটা। অবস্থান জানতে পেরেছ?
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে যেন জামবুর। যত দেরি করে বলা যায়, ততই ভাল। বড় শক্ত কাজ দিয়েছেন আমাকে। কত চেষ্টা করলাম। যখনি ওরা কথা বলেছে, আড়ি পেতেছি। দ্বীপটা সম্পর্কে একটা কথা বলেনি। ওদের জিনিসপত্র…
অতো কথা শুনতে চাই না। দ্বীপটা কোথায় জেনেছ? জেনেছি বলব না, তবে…।
কথা শেষ করতে পারল না জামবু। বিশাল মুঠোর এক ঘুসি এসে লাগল মুখে। ঝটকা দিয়ে ঘুরে গেল মাথা, চেয়ার উন্টে ধুড়ুম করে মেঝেতে পড়ল সে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল, রক্তাক্ত নাক চেপে ধরেছে।
এর জন্যে….এর জন্যে ভুগতে হবে তোমাকে ডেংগু…
ভয় দেখাচ্ছিস? কাছে এসে দাঁড়াল ডেংগু ! জামবুর মনে হল বিশাল এক পাহাড় এসে দাঁড়িয়েছে তার মাথার ওপর। পাহাড়টার হাত রিভলভারের বাঁটে।
আমি…আমি কিছু ভেবে বলিনি, মিস্টার পারভি!
খটাস করে জামবুর কানে পিস্তলের বাটের বাড়ি পড়ল। চুপ, ব্যাটা! খবরদার, আর কখনও আমার নাম মুখে আনবি না। আমি চাই না, এখানে কেউ আমাকে চিনে ফেলুক।
চিনবে না? সবাই তো জানে আপনি অনেক বড় মুক্তা ব্যবসায়ী, সুলু সাগরের থারসডে আইল্যাণ্ড থেকে এসেছেন।
ওখানে জানে, এখানে না। মুক্তার কথা ভাবেই না কেউ এখানে।
বেশ, ডেংগু পারভি নন আপনি। বিষুব অঞ্চলের দক্ষিণ থেকে আসেননি, মুক্তা ব্যবসায়ী নন। তাহলে কে আপনি?
সোজা হল লোকটা। ধুর্ত এক চিলতে হাসি ঠোঁটে ফুটেই মিলিয়ে গেল। আমি? কিছু যদি মনে না কর, তাহলে আমি রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন। আমেরিকায় গো-ইয়ে-ফোর্থ গির্জার পাদ্রী ছিলাম। এখন মিশনারি। সুদুর এই দ্বীপে উড়ে এসেছি এখানকার অসভ্য মানুষগুলোর মনে ঈশ্বরের আলো জ্বালাতে।
গুঙিয়ে উঠল জামবু। আপনার যা ভাবসাব, কি করে বিশ্বাস করাবেন আপনি মিশনারি? দুদুটো খুনের অপরাধে আপনাকে খুঁজছে পুলিশ। ধরতে পারলেই
আবার নিয়ে গিয়ে জেলে ঢোকাবে।
ধরতে পারলে তবে তো। আর বিশ্বাস কিভাবে করাব বলছ? শুনলে অবাক হবে, দোস্ত, আমার বাবা সত্যিই পাদ্রী-ছিল। সানডে ইস্কুলে পড়ালেখা করতে বাধ্য করা হয়েছে আমাকে। বাইবেল আমার মুখস্থ, গড়গড় করে বলে যেতে পারি। মাঝে মাঝে উচ্চারণে গোলমাল করে ফেলি বটে, কিন্তু এখানে কে সেটা বুঝবে? জেলখানার পাদ্রীই ধরতে পারেনি।
কিন্তু এই ছদ্মবেশ কেন?,
ডেংগুর হাসি দূর হয়ে গেল। কেন সেটা আবার জিজ্ঞেস করছ? গর্জে উঠল সে। গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ ছিল, তোমাকে দিয়ে হবে না এই কাজ। মনে মনে তৈরিই ছিলাম, কি করতে হবে।
ছেলেগুলোকে ফাঁকি দেবেন?
নিশ্চয়ই। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে, আমার মত একজন ভদ্রলোককে পেলে খুশিই হবে। ভুলিয়ে ভালিয়ে কথা ঠিকই আদায় করে ফেলব। ইতিমধ্যেই অবশ্য অনেক কিছু জেনে গেছি। বাগ লুকিয়ে রেখেছিলাম প্রফেসরের ল্যাবরেটরিতে। প্রত্যেকটা কথা শুনেছি। প্রফেসর ব্যাটা খুব চালাক। দ্বীপটার অবস্থানের কথা মুখে কিছু বলেনি। ছেলেগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর ওদের পিছু নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডটাও চিনে এসেছি। তবে তাতে তেমন কোন কাজ হয়নি। এক মুহূর্ত থামল সে। কাজ করতে পারার কথা ছিল তোমার। এত পথ একসঙ্গে এসেছ। কিন্তু বুদ্ধ তো, পারবে কি করে।
রিভলভারটা আবার শোল্ডার হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল ডেংগু। জামবুকে দরজা দেখিয়ে বলল, যেতে পার এবার। আমার অনেক সময় নষ্ট করেছ।
কিন্তু জামবু নড়ল না। কথা ভুলে যাচ্ছেন না আপনি?
কথা? কিসের কথা?
আমার টাকা?
কুকুরের মত ঠোঁট ভেঙুচাল ডেংগু। আবার টাকা! কাজটা কি করেছ শুনি? কিছুই জানতে পারোনি, উল্টো ছেলেগুলোর সন্দেহ জাগিয়ে দিয়ে এসেছ। তোমার বরং এখন আমাকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা। যাও ভাগো। নইলে ঘাড় মটকে দেব।
যাচ্ছি, নাকী সুরে বলে দরজার দিকে এগোল জামবু। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকটা নিরাপদ বোধ করল, বলল, এর জন্যে ভুগতে হবে তোমাকে, ডেংগু, কপালে দুঃখ আছে। তোমার সমস্ত জারিজুরি ফাঁস না করে দিয়েছি তো আমার নাম জামবু নয়। এখুনি আমি ছেলেগুলোকে গিয়ে সব বলে দেব।