দ্বীপের একাংশে গড়ে উঠেছে শহর। সেদিক থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এল একটা লঞ্চ। শুকতারার পাশে এসে থামল। লঞ্চ থেকে জাহাজের ডেকে নামল একজন সুদর্শন তরুণ নেভাল অফিসার। পরিচয় দিল, কমাণ্ডার ফেলিক্স ম্যাকগয়ার, পোনাপের ডেপুটি মিলিটারি গভর্নর।
হারিক্যানের স্বাদ তাহলে ভালই পেয়েছেন, বলল অফিসার।
শেষ করে দিয়েছে একেবারে, স্বীকার করল ক্যাপ্টেন। আপনাদের ওপর দিয়েই গেছে নাকি?
না, ভাগ্য ভাল, উত্তর দিয়ে সরে গেছে। কিন্তু আমাদের একটা সাপ্লাই শিপ পড়েছিল ওটার পথে।
তারপর?
ডুবে গেছে। পুরো পাঁচ হাজার টন। আপনাদের এই বাদামের খোসাটা বাঁচল কিভাবে? আশ্চর্য!
গর্বিত ভঙ্গিতে শুকতারার ওপর চোখ বোলাল ক্যাপ্টেন। ছোট জাহাজ তো, তাই। তবে খুব মজবুত। এখানে মেরামত করানোর জায়গা আছে?
আছে। শিপইয়ার্ড।
নিশ্চয় কাগজপত্র দেখতে চাইবেন, বলতে বলতে বের করল কলিগ। পোর্ট চার্জ কত?
হেসে উঠল কমাণ্ডার। লাগবে না। লোকজন খুব একটা আসে না আমাদের এখানে, তাই পোর্ট চার্জ নিয়েও ভাবি না। ছমাসের মধ্যে বাইরের লোক এই আপনারাই এলেন। তা থাকবেন কদ্দিন?।
ও বলতে পারবে, কিশোরকে দেখিয়ে দিল কলিগ। কিশোর পাশা। এই অভিযানের লীডার।
বেশি দিন না, কিশোর বলল। মিস্টার কলিগ তাঁর জাহাজ মেরামত করুন। আমরা শুধু শুধু বসে থেকে আর কি করব? একটা মোটর-বোট ভাড়া করে আশেপাশের যে কটা দ্বীপ পারি, ঘুরে দেখে আসব।
এক মুহূর্ত নীরবতা। আরও বিস্তারিত শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। ম্যাকগয়ার। কিন্তু প্রফেসরের মুক্তাদ্বীপের কথা সবার সামনে কমাণ্ডারকে বলার ইচ্ছে নেই কিশোরের।
বেশ, ম্যাকগয়ার বলল। বোট একটা ঠিক করে দেব। এখন নিশ্চয় তীরে যেতে চাও। উঠে পড়ো আমার লঞ্চে, কে কে যাবে।
ক্যাপ্টেন, রবিন, মুসা আর কুমালো উঠল লঞ্চে। কিশোর উঠতে যাবে, এই সময় কলিগ বলে উঠল, জামবু কই?
দেখি, ডেকে আনি।
ফোরক্যাসলে তাকে পেল না কিশোর। স্টোররুম খুঁজতে গেল। সেখানেও দেখল না। খসখস শব্দ কানে আসতে গিয়ে একটানে খুলল কেবিনের দরজা, যেটাতে ওরা তিনজন থাকে।
ওই তো জামবু। কিশোরের নোটবুক আর ফাইলপত্রের পাতা ওল্টাচ্ছে। এই, কি করছ? তীক্ষ্ণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, কিছু না, ভোঁতা গলায় জবাব দিয়ে, কিশোরকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে। কেবিন থেকে বেরোলো জামবু। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ডেকে। একটা কথা বলল না। চুপচাপ গিয়ে উঠল লঞ্চে।
চিন্তিত হয়ে পড়েছে কিশোর। নিশ্চয় মুক্তাদ্বীপের কথা জানে লোকটা, তার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে চাইছিল কোন তথ্য আছে কিনা। তারমানে প্রফেসর ইস্টউডের প্রাণনাশের হুমকি যারা দিয়েছে, তাদেরই চর জামবু। শুকতারায় উঠেছে
তথ্য জোগাড়ের উদ্দেশ্যে।
যা হবার হয়ে গেছে, লঞ্চে আর কিছু বলল না কিশোর। তবে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে, মুক্তাদ্বীপে তাদের সঙ্গে আর যে-ই যাক, জামবু অন্তত যাচ্ছে না। এমনকি শুকতারা, যখন আবার পাল তুলবে দেশে ফেরার জন্যে, তাতেও মান্না হিসেবে আর নেয়া হবে না লোকটাকে।
দ্বীপটাতে তিরিশ বছর রাজত্বের স্বাক্ষর ভালমতই রেখে গেছে জাপানীরা। পোনাপের বেশিরভাগ স্টোর আর বাড়িঘর তৈরি হয়েছে জাপানী কায়দায়, ওরাই তৈরি করে রেখে গিয়েছে। শহরের বাইরে পাতা দিয়েঙ্কুঁড়ে তুলেছে স্থানীয় অধিবাসীরা।
একটা টিলার মাথায় চমৎকার একটা জাপানী বাংলোতে অভিযাত্রীদের নিয়ে এল কমাণ্ডার। টিলাটার এক ধার খাড়া নেমে গেছে সাগরে। বন্দর চোখে পড়ে ওখান থেকে, দেখা যায় বন্দরের ওপাশের বিশাল উঁচু রক অভ চোকাচ।
এটা তোমাদের বাড়ি,ম্যাকগয়ার বলল। যতদিন মন চায় থাক।
হলুদ মাদুরে এতে খুব আরাম। শুয়ে শুয়েই চোখে পড়ে নীল ল্যাগুনের এখানে ওখানে খুদে খুদে দ্বীপ, সাদা পালতোলা মাছ ধরা নৌকা। দেখা যায়, কয়েক হাজার ফুট উঁচু পর্বতের ওপর থেকে ঝরে পড়া রূপালি জলপ্রপাত।
বেহেশতই এটা, কি বল, কিশোর? মুসা বলল।
কিন্তু তার কথা কিশোরের কানে ঢুকল কিনা বোঝা গেল না। না বলে আবার কোথায় গায়েব হয়ে গেছে জামবু।
১০
শহরে মাত্র একটা বিজনেস স্ট্রীট। কাজেই পোস্ট এক্সচেঞ্জটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না জামবুর।
ভেতরে ঢুকে এমন ভাব করল, যেন এখানে তার সঙ্গে কারও দেখা করার কথা। বিশালদহেী এক লোক এগিয়ে এল, পিঠটা সামান্য কুঁজো। হাসল না। হাত বাড়িয়ে দিল না। রূঢ়কণ্ঠে বলল, এতক্ষণে এলে? জাহাজটা সেই কখন ঢুকতে দেখলাম। আধ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি: এখানে। চোখে সন্দেহ নিয়ে আড়চোখে তাকাল একবার ক্লার্কের দিকে। বেরোও। এখানে কথা বলা যাবে না।
মেইন রোড ধরে এগোল ওরা। পয়লা মোড়টাতেই ঘুরে নেমে পড়ল একটা গলিতে। এঁকেবেঁকে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে পথটা, পাতার কুঁড়েগুলোর মাঝখান দিয়ে। প্রতিটি বাড়িতেই বাগান আছে। বাতাসে ফুলের সুবাস, জ্যাসমিন, ফ্র্যাঙ্গিপ্যানি, সিন্যামোন, আর আল্পও নানা জাতের ফুল। বিশাল একটা রুটিফল গাছের নিচ দিয়ে চলল দুজনে, ফুটবলের সমান বড় বড় ফল ধরে আছে গাছটাতে। পথে ওরকম আরও ডজন খানেক গাছ পড়ল। আরও নানারকম উদ্ভিদ। একটা বোটানিকেল গার্ডেনে এসে হাজির হয়েছে যেন।
গাছপালার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ে এখানকার মানুষগুলো। পুরুষেরা ছয় ফুটের বেশি লম্বা, পেশিবহুল শরীর, বাদামি চামড়া। মেয়েরাও কম লম্বা নয়। খোঁপায় সাদা ফুল গোঁজা, কিংবা মালা জড়ানো। হাসিখুশি মোটাসোটা শিশু তাদের কোলে। রাস্তার ওপর বসে আছে একটা সুন্দর বাচ্চা। বিশালদেহী লোকটার দিকে চেয়ে ফোকলা হাসি হাসল।