বাতলে দিল ক্যাপ্টেন। কুমালোকে নিয়ে কাজে লেগে গেল ছেলেরা। ছোট মাস্তুলটাকে টেনে-হিঁচড়ে প্রধান মাস্তুলের কাছে নিয়ে গিয়ে এক করে পেঁচিয়ে বাঁধল। তারপর দুটোর মাঝামাঝি জায়গায় শক্ত দড়ি বেঁধে দড়ির, আরেক মাথা বাঁধল গলুইয়ের কাছে নোঙর বাধার খুঁটিতে। যেসব দড়িতে মাস্তুলগুলো আটকে রয়েছে ওগুলো কেটে দিতেই পিছলে গিয়ে পানিতে পড়ল মাস্তুল দুটো। সোজা হয়ে গেল জাহাজ।
আরেকটা ব্যাপার ঘটল। ভারি মাস্তুলগুলো ডুবে ডুবে ভেসে রয়েছে পানিতে। বাতাস লাগছে না, ঘোরাতেও পারছে না ওগুলোকে, কিন্তু জাহাজটাকে ধাক্কা দিয়ে সহজেই ঘুরিয়ে ফেলছে। নোঙরের কাজ করছে এখন মাস্তুল দুটো। টান লেগে জাহাজের মুখ ঘুরে গেল বাতাসের দিকে, ঢেউয়ের মুখোমুখি। ফলে বাতাসের চাপ যেমন কমল অনেকখানি, ঢেউয়ের আঘাতও। দুপাশ দিয়ে কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাতাস আর ঢেউ দুটোই।
আরও একটি ঘন্টা ঝড়ের সঙ্গে প্রাণপণে ঝুঝলো ছোট্ট জাহাজটা। কোনমতে ভেসে রইল পানির ওপরে।
তারপর যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি গর্জন করতে করতে পেছনে সরে গেল ঝড়।
আবার দেখা দিল নীল আকাশ। বেরিয়ে এল সূর্য। বারো নট গতিতে পশ্চিমে সরে যাচ্ছে বাতাসের প্রচণ্ড ঘূর্ণি।
ঝড় সরে যাওয়ার পর আরও ফুসে উঠল সাগর, বাতাসের চাপ হঠাৎ কমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া। তারপর শান্ত হয়ে এল আস্তে আস্তে। ঢেউ আছে, তবে ছোট, ডেকের ওপরে আর উঠতে পারছে না, পানিও ঢুকছে না আর কোলে। জিততে শুরু করেছে পাম্প। আগেরমত ভেসে উঠছে জাহাজ।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল জাহাজের ছজন মানুষ। মনে মনে ধন্যবাদ দিল ঈশ্বরকে, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী।
ট্যাংকগুলোর অবস্থা দেখতে গেল কিশোর। সব কটার ঢাকনা লাগানো রয়েছে। পানি কানায় কানায় ভরা। ফলে কোন ক্ষতি হয়নি ভেতরের অধিবাসীদের। আনন্দেই আছে, এতবড় একটা ঝড় যে গেল যেন বুঝতেই পারেনি।
মাস্তুলগুলোর কি হবে? ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। ফেলে দিয়ে যাব?
না। পোনাপতে গিয়ে ঠিকঠাক করে আবার লাগাব।
কাজ চালানোর মত মেরামত হল হালটা। কিন্তু পাল আর তোলা গেল না। ছোট্ট ইঞ্জিনের ক্ষমতা নিঙড়ে, ভারি দুটো মাস্তুল পেছনে টানতে টানতে, ধুকে ধুকে পোনাপের দিকে এগিয়ে চলল শুকতারা।
৯
প্রায় অচেনা-সাগরে এসে পড়েছে এখন জাহাজ। ক্যাপ্টেন কলিগও এখানে আসেনি কখনও। কোন জাহাজ চোখে পড়ল না, জাহাজপথ এখান থেকে অনেক দূরে, উত্তরে এবং দক্ষিণে।
দুটো বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়টা এই অঞ্চল জাপানের দখলে ছিল। অন্য কোন দেশের জাহাজকে ঢুকতে দিত না এখানে। জাপান ছাড়া বাইরের দুনিয়ার আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না এখানকার আড়াই হাজার অধিবাসীর। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে আসত অন্য দেশের অভিযাত্রীরা।
অবস্থা এখনও প্রায় সেই একই রকম রয়েছে, কর্তৃত্ব হাতবদল হয়েছে মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, ইউনাইটেড নেশনসের হয়ে দ্বীপগুলো শাসন করছে এখন ইউনাইটেড স্টেটস।
আমেরিকান নৌবাহিনীর যেসব লোক কর্মরত রয়েছে এখানে, তাদের মনে হয়, পৃথিবীতে নয়, অন্য কোন গ্রহে বন্দি জীবনযাপন করছে। জীবনে কোন উত্তেজনা নেই, নতুনত্ব নেই, কাজেই ভাঙাচোরা শুকতারা আর এর অধিবাসীদের দেখে স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনা সৃষ্টি হল তাদের মাঝে। পোনাপেতে অতিথির আগমন!
অতিথিরাও উত্তেজিত, বিস্মিত। ভাঙা জাহাজ থেকে মাটিতে পা রাখার জন্যে যেন আর তর সইছে না। এত সুন্দর দ্বীপ আর দেখেনি ওরা।
আরিব্বাবা, এত সুন্দর! মুগ্ধ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। সাদা সৈকত, নীল ল্যাগুন, আর সবুজে ছাওয়া আকাশচুম্বী পর্বত। মনে হয় ছবি। পর্বতের ঢালে – সাজিয়ে রাখা হয়েছে যেন নারকেলগুচ্ছ, ডালা ছড়ানো আমগাছ, বিশাল বট আর অন্যান্য শত শত জাতের গাছপালা, ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে, ছেয়ে আছে ফুলে ফুলে। ঠিকই নাম রেখেছিল প্রাচীন স্পেনের নাবিকেরা–বাগানদ্বীপ।
দক্ষিণ সাগরের নিচু প্রবাল অ্যাটলগুলোতে বৃষ্টিপাত প্রায় হয়ই না, অথচ পোনাপের আবহাওয়া এর উল্টো। প্রচুর বৃষ্টি হয়। ঝড়বাদলকে স্বাগত জানিয়ে ডেকে আনে পর্বতের উঁচু উঁচু চূড়াগুলো। এই যে এখন, চারপাশে ঝকঝকে রোদ, এই এখনও টটল নামের চূড়াটার ওপর জমে রয়েছে কালো মেঘ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে।
খাইছে! ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার চোখ।
খালি যে তাহিতি আর সামোয়ার কথা বলে লোকে, রবিন বলল। এর চেয়ে ভাল?
ধারেকাছে আসতে পারবে না, ক্যাপ্টেন বলল। ওই দুটো দ্বীপ দেখেছে সে।
তাহলে এটার কথা বেশি শোনা যায় না কেন?
লোকে বেশি আসতে পারে না বলে।
আরি, একেবারে দেখি জিবরালটার! বলে উঠল মুসা।
হ্যাঁ, একেবারে জিবরালটারের মতই। চার্ট বলছে, ওটার নাম রক অভ চোকাচ। বন্দরের ওপরে নশো ফুট উচু হয়ে আছে। ব্যাসল্টের পাহাড়, ঢল এত খাড়া, দুঃসাহসী পর্বতারোহীও ওঠার আগে দশবার দ্বিধা করবে।
প্রবাল প্রাচীরের একটা ফাঁকের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল শুকতারা। দ্বীপের সৌন্দর্য যেন চুইয়ে এসে পড়েছে ল্যাগুনেও। তীরের খুব বেশি কাছে যাওয়া গেল না, বিপজ্জনক চড়ার জন্যে। দশ ফ্যাদম পানিতে নোঙর ফেলল ক্যাপ্টেন।…
কিছু মাছধরা নৌকা আর নেভির বিশেষ জলযান ছাড়া কোন জাহাজ নেই বন্দরে। বিমান একটা দেখা গেল, ক্যাটালিনা বিমান, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে যেন।