প্রথম কারণ, স্কুনারটা কাঠের তৈরি। কাঠ পানিতে ভাসে, ইস্পাত ভাসে না। বড় যে-কোন একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে যেতে পারছে ছোট বলে। বড়গুলো পারে না, ওগুলোর নিচে পড়ে একাধিক ঢেউ। ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথায় চড়ে বসতে পারে না, ফলে মার হজম করতে হয়। ভয়ঙ্কর চাপে বেঁকেচুরে ফেটে যায় খোল। – শাঁ করে একবার ঢেউ-পর্বতের চূড়ায় উঠে যাচ্ছে শুকতারা, তীব্র গতিতে আবার নামছে অন্ধকার উপত্যকায়। এদিকে কাত হচ্ছে, ওদিকে কাত হচ্ছে, দুলছে, গড়াচ্ছে, কিন্তু ডুবছে না, ভেসে রয়েছে কোনমতে।
শত শত পাখি এসে ঢুকেছে,এই কেন্দ্রবিন্দুতে। নাগালের মধ্যে যতগুলোকে। পেয়েছে, ঝেটিয়ে সব নিয়ে এসেছে যেন বাতাস। নুডি, বুবি, গাল, ডানা কাপাতে কাপাতে এসে বসছে ডেকে, ওপর থেকে খসে পড়ছে যেন। ডিঙির ওপরে এসে ঠাই নিল দুটো মস্ত ফ্রিগেট পাখি। শুধু পাখিই না, পাখাওয়ালা আরও জীব এসেছে, হাজারে হাজারে পতঙ্গ প্রজাপতি, মথ, মাছি, মৌমাছি, বোলতা, ঘাসফড়িং। ঝাকে ঝাকে এসে ছেয়ে ফেলছে মাস্তুল, পালের দড়ি। হাতে লাগছে, মুখে লাগছে, কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে বিচিত্র সুরে।
উত্তর-পুবমুখো এগোচ্ছে জাহাজ। হঠাৎ ওটার নাক দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরিয়ে ফেলল ক্যাপ্টেন।
এরকম করলেন কেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
করলাম, যাতে ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে এগোতে পারে।
ঝড়টা এল আবার, আচমকা। আরেকটু হলেই উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল কিশোরকে। আবার শুরু হল বাতাসের গর্জন। হাতে মুখে বিধছে পানির কণা। অদৃশ্য হয়ে গেছে নীল আকাশ, মাথার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে যেন কালো ভূতুড়ে অন্ধকার।
আগের বারের চেয়ে ঢেউগুলো, এখন ছোট, মাস্তুল ছাড়িয়ে যাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর কোন উদ্দেশ্য নিয়েই বুঝি ছুটে চলেছে একদিকে।…
একটা ব্যাপার পরিষ্কার, হারিক্যানের প্রথম আঘাতের চেয়ে দ্বিতীয়টা খারাপ : হবে।বাতাস এবং ঢেউ, দুটোরই জোর বেশি। উধাও হয়ে গেল পাখি আর পতঙ্গ, যেন ভেল্কিবাজি। টুকরো টুকরো হয়ে গেল মাস্তুল, পাল যে কটা ঝুলছিল, ছিঁড়ে ফালাফালা। বুমটা ভেঙে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ঝুলতে লাগল ডেকের ওপর।
ভাঙা মাস্তুলের গোড়ায় নিজেদেরকে বাঁধার সাহস আর হল না তিন গোয়েন্দার। কুমালোর পদ্ধতি অনুকরণ করে টিকে রইল কোনমতে। জামবু কোথায় ভেবে অবাক হচ্ছে।
জাহাজটাকে দুদিক থেকে ধরে ভীষণ ভাবে আঁকাচ্ছে যেন কোন দানব। মড়মড় করে শব্দ হল পেছনে, টিল হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের হাতের হুইল।
হালটা গেল! চিৎকার করে বলল কলিগ।
বাতাসের দিকে পেছন করে আর থাকতে পারল না শুকতারা। নিজের নিয়ন্ত্রণ শেষ। বাতাস এখন যেদিকে ঘোরাচ্ছে সেদিকেই ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে। টেউয়ের তাথৈ নাচের মাঝে পড়ে বাদামের খোসার মত দুলতে লাগল, অসহায়।
প্রতিবার গড়ানোর সময় কয়েক টন করে পানি বয়ে যাচ্ছে ডেকের উপর দিয়ে, নিচে নামার পথ বেয়ে নেমে চলে যাচ্ছে খোলে।
পাম্প চালু করে দিয়েছে ক্যাপ্টেন, কিন্তু সেঁচে সারতে পারছে না। কুলিয়ে উঠতে পারছে না পাম্প, ফলে জমে যাচ্ছে পানি।
ঘুমিয়ে পড়েছিল জামবু। নাকে পানি ঢুকতে জাগল। দেখল, নোনা পানিতে। ডুবে আছে সে, ফুসফুসে ঢুকতে শুরু করেছে পানি। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটল। হাঁসফাঁস করছে, কাশছে। কত তাড়াতাড়ি এখন ডেকে উঠবে কেবল সেই চেষ্টা।
প্রকৃতিও যেন খেলতে আরম্ভ করেছে দুষ্ট জামবুকে নিয়ে। ডেকে উঠেও সারতে পারল না সে, প্রচণ্ড এক ঢেউ এসে তাকে ভাসিয়ে নিল রেলিঙের দিকে।
পড়ে গেল! পড়ে গেল! চিৎকার করে উঠল ক্যাপ্টেন।
চিৎকারটা সবে বেরিয়েছে তার মুখ থেকে, এই সময় ফিরতি আরেকটা ঢেউ আবার জামবুকে এনে ডেকে আগের জায়গায় ফেলল। তার বোকা-হয়ে-যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল ছেলেরা।
জলদি উঠে ধর কোন কিছু, তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল ক্যাপ্টেন। নইলে আবার নিয়ে যাবে। সাগরে পড়লে আর উঠতে হবে না।
জামবুর দিকে বেশিক্ষণ নজর দেয়ার সময় কারও নেই। খুনী বাতাস পলিনেশিয়ানরা বলে হারিক্যানকে—শুকতারাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যেন।
ভীষণ ভাবে দুলে উঠল জাহাজ। গোড়া থেকে মড়মড় করে ভাঙল প্রধান মাস্তুল। দড়িদড়ায় আটকে থাকায় পানিতে পড়ল না, ওটার ভারে বাঁ পাশে কাত হয়ে গেল জাহাজ। কয়েক মুহূর্ত পরে সামনের মাস্তুলটা ভাঙল, ডিঙির ওপর পড়ে গুঁড়িয়ে দিল ডিঙিটাকে।
আনন্দ ভ্রমণ শেষ। এখন আর জাহাজ বলা যাবে না শুকতারাকে, জাহাজের ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। যাত্রীরা প্রাণে বাঁচবে কিনা এখন তার আর বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই।
নোঙর ফেলো, নোঙর! চেঁচিয়ে উঠল কলিগ।
থোলের মধ্যে পানি। প্রতিটি ঢেউ এখন গড়িয়ে যাচ্ছে জাহাজের ওপর দিয়ে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত যোগ হল এর সঙ্গে বৃষ্টি। এক ফোঁটা দুফোঁটা নয়, মুষলধারে। অবিশ্বাস্য রকমের বড় বড় ফোঁটা।
এতক্ষণে বিশ্বাস করল কিশোর, হারিক্যানের ভয়াবহতা আর বৃষ্টি সম্পর্কে যা শুনেছে, সব সত্যি। হারিক্যানের সময় ফিলিপাইনে মাত্র চারদিনে যা বৃষ্টিপাত হয়, তা ইউনাইটেড স্টেটস-এর পুরো এক বছরের বৃষ্টিপাতের সমান।
এই বৃষ্টির চেয়ে মাথার ওপর ঢেউ ভেঙে পড়া অনেক আরামের ছিল।
কোথাও গিয়ে মাথা গোঁজার সময় নেই, উপায়ও নেই। এক্ষুনি নোঙর ফেলতে না পারলে বাঁচানো যাবে না জাহাজটাকে। কিন্তু কিশোর বুঝতে পারল না এই গভীর পানিতে নোঙর ফেলবে কি করে?