মাথা সামান্য নোয়ালেন ধূসর-চুল প্রফেসর, যাতে ট্রাইফোকাল লেন্সের ভেতর। দিয়ে ভালমত দেখতে পারেন কিশোর অতিথিদের।
আমান বলল, প্রশান্ত মহাসাগরে নাকি বেড়াতে যাচ্ছ তোমরা, হাসলেন প্রফেসর। কিছু সামুদ্রিক জীব ধরারও চেষ্টা করবে। খুব কঠিন আর বিপজ্জনক কাজ। বয়েস কম তোমাদের। পারবে?
পারব, স্যার, গভীর আত্মবিশ্বাস ফুটে বেরোলো কিশোরের কণ্ঠে। আমাজানের জঙ্গলে গিয়ে ভয়ঙ্কর অ্যানাকোণ্ডা আর মারাত্মক হিংস্র জাগুয়ার ধরে এনেছি এই আমরা তিনজন। ভীষণ অরণ্যে সেই রোমাঞ্চকর অভিযানের কাহিনী সংক্ষেপে তাঁকে বলল সে।
বেশ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন প্রফেসর। আমানকে আমি বহু বছর ধরে চিনি। তার ওপর আস্থা আছে আমার। তোমাদের কথা বলেছে আমাকে। বয়েস এত কম হবে ভাবিনি…্যাকগে, সে যখন বলেছে, ঠিকই বলেছে। ফিল্ম ডিরেক্টর ডেভিস ক্রিস্টোফারকে ফোন করেছিলাম, সে-ও শতমুখে প্রশংসা করল তোমাদের। ওর মত লোককে অবিশ্বাস করতে পারি না। শোন, হাইলি কনফিডেনশিয়াল একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করব এখন। ডেনজারাস! দুবার মরতে মরতে বেঁচেছি এর জন্যে। তিনবার আমার এই ঘরে হানা দিয়েছে চোর, ফাইলপত্র তছনছ করেছে, রাতের বেলা। খুঁজে পায়নি অবশ্য, কারণ কোন কাগজে লিখিনি ওই তথ্য, লেখা আছে এখানে, নিজের কপালে টোকা দিলেন তিনি।
তোমাদের জানাব সেকথা, বললেন তিনি। জানলেই বিপদ, জীবন বিপন্ন হবার ভয় আছে। যতক্ষণ না জানছ, ভাল আছ। সে-তথ্যের জন্যে হয়ত অত্যাচার করে তিলে তিলে মারা হবে তোমাদের। ভেবে দেখ এখন, ঝুঁকি নেবে কিনা? একে একে তিনজনের মুখের দিকে তাকালেন প্রফেসর।
আড়চোখে একবার দুই বন্ধুর মুখের দিকে তাকাল গোয়েন্দাপ্রদান। রবিন স্তব্ধ, মুসার চেহারা ফ্যাকাসে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর। শান্তকণ্ঠে বলল, সব খুলে বলুন।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত কিশোরের চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর। তারপর হাসি ফুটল মুখে। নাহ, আণ্ডার এস্টিমেট করেছিলাম তোমাদের, কম বয়েসী বলে ভুল করেছি। আমান আর ক্রিস্টোফার ঠিকই বলেছে। মনে হচ্ছে পারবে তোমরা। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা ম্যাপ বের করে টেবিলে বিছালেন তিনি। মেরুদণ্ডে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল কিশোরের। জলদস্যুর গুপ্তধন? সাগরের কোন দুর্গম এলাকায় সেই ধন নিয়ে ডুবে গেছে কোন স্প্যানিশ জাহাজ? ম্যাপটা কি তারই নকশা?
সামনে ঝুঁকে ম্যাপটা দেখল সে। ও, না, নকশা নয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কোম্পানির করা একটা ম্যাপ, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের, হাওয়াই থেকে তাইওয়ান পর্যন্ত আঁকা রয়েছে। ম্যাপটা বেশ বড় আর আধুনিক, ছোট ছোট অসংখ্য দ্বীপ দেখানো রয়েছে, যেগুলো সাধারণ ম্যাপে থাকে না।
চেয়ার থেকে কিছুটা উঠে রবিনও দেখল। কয়েকটা দ্বীপের নাম জানে, হাওয়াই, তাহিতি, সামোয়া, ফিজি। বেশির ভাগই জানে না, বিশেষ করে লাল পেন্সিল দিয়ে গোল দাগ দেয়াগুলো, প্রফেসর দিয়েছেন। যেমন, পোনাপে,ট্রাক, ইয়্যাপ, ওলোল, লোস্যাপ, প্যাকিন, পিনজিল্যাপ। অদ্ভুত আরও কিছু নাম রয়েছে, কতগুলোর নাম উচ্চারণ করাই কঠিন।
কয়েকটা দ্বীপ ঘিরে রয়েছে গোল একটি মাত্র দাগ। সেটাতে পেন্সিল ঠকে প্রফেসর বললেন, এই যে জায়গাটা, একে বলে প্রশান্ত মহাসাগরের অন্ধ অঞ্চল। এখানে রয়েছে পঁচিশ হাজারের মত প্রায় অচেনা দ্বীপ। জাপানীরা দখল করে রেখেছিল এগুলো, বহুবছর বাইরের কোন জাহাজকেই ঘেঁষতে দেয়নি এই এলাকায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এগুলোর হাতে গোনা কয়েকটা দ্বীপে লড়াই হয়েছিল ওদের, মিত্রবাহিনীর সঙ্গে। জাপান হেরে যায়। দ্বীপগুলো দেখাশোনার ভার এখন আমেরিকার ওপর। কয়েকটা দ্বীপে আমেরিকান নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে। হারানো পৃথিবীই বলা চলে অঞ্চলটাকে।
তবে ওই হারানো পৃথিবীই আমার জন্যে স্বর্গ, তোমাদের জন্যেও হবে, কারণ, দুর্লভ জলজ জীব ধরতে যাচ্ছ তোমরা। আমার কাছে প্রিয় হবার আরেকটা বড় কারণ, ওখানেই রয়েছে আমার মুক্তার খামার।
মুক্তা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
আস্তে বল, চট করে ঘরের চারপাশে চোখ বোলালেন প্রফেসর, কেউ শুনে ফেলল কিনা দেখলেন বোধহয়। পেন্সিলের মাথা রাখলেন পোনাপে নামের দ্বীপটার ওপর। এটার উত্তরে—ঠিক কত দূরে বলতে পারব না ছোট একটা অ্যাটুল। আছে। কেউ থাকে না ওখানে। এত ছোট, ম্যাপে দেখানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি। জাহাজ চলাচলের পথ থেকে দূরে, কাজেই নটিক্যাল চার্টেও দেখায়নি। নাম ছিল না। সুতরাং নাম একটা আমিই রেখেছি, পার্ল ল্যাগুন। ওই ল্যাগুনে গবেষণা চালিয়েছিলাম কিছুদিন।
পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর মুক্তা ফলানো হয় পারশিয়ান গালফ-এ। বছর পাচেক আগে ওই গালফ থেকে বিশ হাজার ঝিনুক সংগ্রহ করে পার্ল ল্যাগুনে নিয়ে যাই আমি, প্রাকৃতিক পরিবেশে ওই ঝিনুক থেকে কি-রকম মুক্তা হয় দেখার জন্যে। ওই ঝিনুকের জন্যে প্রচুর খাবারও নিয়ে যাই। পারশিয়ান গালফ-এর পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছি পার্ল ল্যাগুনে। আমার বিশ্বাস ছিল, ওখানেই ওই ঝিনুকের চাষ সফল হলে আরও অনেক জায়গায় করা সম্ভব হবে।
আমার পরীক্ষা সফল হয়েছে কিনা দেখার সময় হয়েছে এখন। সময়ের অভাবে যেতে পারছি না আমি, খরচ দিয়ে যে কাউকে পাঠাব, সে সামর্থ্যও নেই। তোমরা যখন ওদিকেই যাচ্ছ, পারলে একবার পার্ল ল্যাগুনে যেও, আমার ঝিনুক খেত থেকে কিছু নমুনা নিয়ে এস। তোমরা যেখানে যাবে, তার থেকে কিছুটা দূরেই হবে ল্যাগুনটা। তবে ওইটুকু যেতে আসতে যা খরচ লাগে, সেটা আমি দিতে পারব। পারবে যেতে?