ভাগ্যিস সময়মত মাস্তুলের সঙ্গে শরীরটা পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলেছিল পালের দড়ি দিয়ে! আরও দুটো মাস্তুলে বাঁধা অবস্থায় মুখ গুঁজে রয়েছে কিশোর আর মুসা। কুমালো মুক্তই রয়েছে, জাহাজের সঙ্গে তাল রেখে একবার এদিকে কাত হয়ে। যাচ্ছে, একবার ওদিকে, বাতাসে ঝুলন্ত ডালে আঁকড়ে বানর যে-রকম করে ঠিক তেমনি। ককপিটের মেঝেতে শুয়ে আছে ক্যাপ্টেন, এক হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে হুইলের নিচের দিকের একটা স্পেক। জামবু নেই। নিশ্চয় নিচের মালপত্র সামলাতে ব্যস্ত, ভাবল রবিন।
কিন্তু মাল নয়, নিজেকেই এখন আর সামলাতে পারছে না জামবু। ভেবেছিল আরাম করে শুয়ে থাকবে। ঝড় বাড়তেই বুঝল, মস্ত ভুল করে ফেলেছে। সাগর যেন বল খেলতে শুরু করল তাকে নিয়ে। দেয়াল থেকে একবার মেঝেতে ছুঁড়ে মারে, আবার মেঝে থেকে দেয়ালে। ঘরের একপাশে একটা বাংক আছে। কোনমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে গিয়ে উঠল ওটাতে। ধার খামচে ধরে উপুড় হল। ভাবল, যাক বাঁচা গেল। কিন্তু বাঁচতে পারল না। ওটাও ছুঁড়ে মারল তাকে। আরও দুঃখ যোগ হল তার কপালে, জীবন্ত হয়ে উঠল যেন মালপত্রগুলো। সে যেদিকে যায়, ওগুলোও ছুটে যায় সেদিকে, কে কত জোরে এসে তার গায়ে লাগতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় মেতেছে যেন।
আতঙ্কে, ব্যথায় প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হল জামবুর। মেঝেটা আরেকবার সোজা হতেই ঝাঁপিয়ে এসে দরজায় পড়ল সে। পাল্লা খোলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। জোরে জোরে ধাক্কা মারতে লাগল কাঁধ দিয়ে। ব্যথাই পেল শুধু কাঁধে, পাল্লার কিছু করতে পারল না। আগের মতই অনড় রইল ওটা।
উড়ে এসে মাথায় লাগছে নানারকম বাক্স, টিন। পাগলের মত দরজায় কিল মারতে মারতে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে শুরু করল সে। ঝড়ের এই ভয়াবহ শব্দের মাঝে তার ডাক কারও কানে পৌঁছবে না, বুঝল। বড় একটা বাক্স তুলে গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল দরজায়। কিন্তু অন্যপাশে বাতাসের হাত আরও শক্ত, বিন্দুমাত্র নড়তে দিল না পাল্লাটাকে। ভাল জেলখানাতেই আটকে পড়েছে সে!
ভীষণ অনুশোচনা হল তার, কাঁদতে শুরু করল। জোরে জোরে বলতে লাগল, এখান থেকে যদি জীবন্ত বেরোতে পারে, মদ খাওয়া ছেড়ে দেবে, জীবনে আর বোতল ছুঁয়ে দেখবে না। আর কখনও কাজে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে না। খারাপ কাজ করবে না। একেবারে ভাল হয়ে যাবে, দুধে ধোঁয়া, বিমল, পরিষ্কার।
যেন তার ডাক শুনতে পেলেন ঈশ্বর, করুণা করলেন ক্ষণিকের জন্যে। ঝটকা দিয়ে হঠাৎ খুলে গেল পাল্লা। ওটার ওপরই কাত হয়ে হেলান দিয়ে ছিল জামবু, পড়ে গেল করিডরে। জোর বাতাসে পেছনে আবার দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা। মালপত্রের মার খাওয়া থেকে বাঁচল অন্তত সে।
উপুড় হয়ে পড়ে থেকে খুব অল্প সময়েই প্রতিজ্ঞা ভুলে গেল জামবু। কাজ করে মরুকগে কুমালো, তার কি? সুবিধেমত একটা জায়গা বেছে নিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। অনেক ধকল গেছে, জিরিয়ে নেয়া দরকার।
একটানা বাতাস বওয়া বন্ধ হল, থেকে থেকে আসছে এখন ঝাপটা। কমছে বাড়ছে, কমছে বাড়ছে, এরকম করতে করতে থেমেই গেল একেবারে। কানফাটা গর্জনের পর এই স্তব্ধ নীরবতা আরও ভয়ঙ্কর মনে হল রবিনের। ছেড়া ছেড়া মেঘগুলো অদৃশ্য হয়ে গিয়ে ফুটে বেরোলো নীল আকাশ।
আল্লাহ্, বাঁচলাম! চেঁচিয়ে বলল মুসা। গেছে মরার তুফান!
রবিনের তা মনে হল না।
কলিগ বলল, অর্ধেকটা গেছে।
পানির ঘূর্ণির মতই পাক খেয়ে খেয়ে চলে হারিক্যানের বাতাস। একশো থেকে দুশো মাইল গতিতে। ঘোরার গতি প্রচণ্ড, কিন্তু সরার গতি খুব কম, বড় জোর ঘন্টায় বারো মাইল।
এই ঘূর্ণির মাঝখানে রয়েছে ঝড়ের চোখ, খুব শান্ত, বাতাস প্রায় থাকেই না কেন্দ্রবিন্দুতে।
বেশি হলে আধ ঘন্টা, ক্যাপ্টেন বলল। তারপরই অন্যপাশের দেখা পাব আমরা।
যার যার বাঁধন খুলে কুমালোর কাজে সাহায্য করতে গেল তিন গোয়েন্দা। জাহাজের ভেতরে বাইরে সব তছনছ করে দিয়েছে ঝড়। আরেকটু হলেই দড়ি ছিঁড়ে সাগরে পড়ে যেত ডিঙিটা, কোনমতে আটকে আছে।
কাজ করতে করতে ঘামছে ওরা। বাতাস খুব পাতলা, গরম, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
ঝড় নেই, তবুও জাহাজটা এত দুলছে কেন প্রথমে বুঝতে পারল না কিশোর। ঝড় যখন ছিল, তখনকার চেয়ে বড় আর এলোমেলো ঢেউ এখন সাগরে। আসলে তখন বাতাসের গতি একটা বিশেষ দিকে ছিল, নিয়ন্ত্রণ ছিল পানির ওপর। এখন নেই। ফলে উত্তাল হয়ে উঠেছে পানি, যেন যা-ইচ্ছে-করার খেলায় মেতেছে। লাফিয়ে উঠছে ঢেউ, পঞ্চাশ ফুট, ষাট ফুট ওপরে গিয়ে ফাটছে, ঝরে পড়ছে। ফোয়ারার মত। যেন পানির নিচে জাহাজ বিধ্বংসী টর্পেডো ফাটানো হচ্ছে একের পর এক।
চারদিকে দাপাদাপি করছে পানি, ঢেউ আছড়ে ভাঙছে ঢেউয়ের ওপর, সৃষ্টি করছে হাজারো ফোয়ারা, অসংখ্য জলপ্রপাত।
পানির এই অস্থিরতার কারণও এখানে বাতাস নেই বলে। প্রচণ্ড গতিতে। চরকির মত পাক খেয়ে বাতাস ঘুরতে ঘুরতে মাঝখানে সৃষ্টি করেছে ফাঁপা শূন্যতা। বাতাসের চক্র ভেদ করে বেরোতে পারছে না ঢেউ, ফলে সবদিক থেকে ধেয়ে আসছে কেন্দ্রের দিকে, মহা-অনর্থ বাধিয়েছে এসে এই শূন্যস্থানে।
বড় যাত্রীবাহী জাহাজ কিংবা মালবাহী স্টীমার হলে এই অত্যাচার সহ্য করতে পারত না, ঠাই নিত গিয়ে এতক্ষণে সাগর দেবতার ভঁড়ারে। শুকতারা ছোট বলেই পারছে। এ-ধরনের আবহাওয়া সহ্য করার ক্ষমতা বড়গুলোর চেয়ে ছোট জলযানগুলোর বেশি।