ফুসফুসের সমস্ত বাতাস নিঙড়ে বের করে নিয়ে গেছে যেন পানি। হাঁ করে দম টানতে গিয়ে নাকমুখ দিয়ে ঢুকল নোনা পানি। নিঃশেষ হয়ে আসছে শক্তি। পুরো ব্যাপারটাই কেমন অবাস্তব লাগছে। ডেকের চল্লিশ ফুট ওপরে বসে থেকে পানিতে ডুবল কিভাবে?
কিশোর কই? আর মুসা? ডেক থেকে ধুয়ে নিয়ে গেছে ওদেরকে পানি? এই তাহলে হারিক্যান! মাস্তুলটা আবার সোজা হয়েছে বলে মনে হল। নিচে তাকাল সে। ডেকটা যেখানে থাকার কথা সেখানে শুধু পানির ঘূর্ণি।
সরে গেল পানি। লাফ দিয়ে আবার বেরিয়ে এল যেন ডেকটা। কিশোর আর মুসাকে দেখা গেল। দুই মাস্তুলের সঙ্গে যার যার শরীর বেঁধে নিয়েছে। মরে গেছে
বেঁচে আছে বোঝার জো নেই। তবে আছে জাহাজেই, সাগরে ভেসে যায়নি, এটুক নিশ্চিত হওয়া গেল। ককপিটের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে ক্যাপ্টেন। মহাপ্লাবনের ভেতর থেকে যেন একটা সীমাছের মত বেরিয়ে এল কুমালো। এগিয়ে গেল হালের দিকে, জখমী হালটাকে মেরামত করার জন্যে।
জামবুর ছায়াও চোখে পড়ল না।
কিন্তু জামবু আছে। মাত্র চুমুক দিয়েছে বোতলে। পানীয়টা পেটে গিয়েও সারতে পারেনি, মাথায় লাগল প্রচণ্ড বাড়ি। তুলে নিয়ে বাল্কহেডের গায়ে ছুঁড়ে মারল যেন তাকে কেউ। গায়ের ওপর এসে পড়ল, বাক্স, টিন, বস্তা আর আরও নানারকম জিনিস। একটা ময়দার বস্তা ছিঁড়ে গিয়ে ময়দায় মাখামাখি হয়ে গেল তার সমস্ত শরীর। জিনিসপত্রের স্তুপের নিচে, দেয়ালে উপুড় হয়ে পড়েছে সে, মাথা ঠেকে আছে ছাতের সঙ্গে। খানিক পরে গড়িয়ে সরে গেল জিনিসগুলো, মুহূর্ত পরেই ফিরে এল আবার দ্বিগুণ বেগে, বাড়ি মেরে, চাপ দিয়ে, নীল করে দিল তাকে।
অনেক কষ্টে চার হাতপায়ে ভর দিয়ে টেনে তুলল শরীরটা। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। শক্ত হয়ে লেগে গেছে পাল্লা। খুলতে পারল না। তালা। লাগেনি। তালা নেই-ই, লাগবে কি করে? কিন্তু তবু খুলতে পারল না। দরজার ওপাশে প্রচণ্ড গর্জন।
বাতাস তাহলে এল অবশেষে। এমনভাবে ঠেলে ধরে রেখেছে পাল্লা, যেন পেরেক দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ওটাকে। কাত হয়ে আছে ঘরটা। দেয়ালে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল জামবু।
জিনিসপত্র ওড়াউড়ি থেমেছে। এখন বাইরে বেরোনো গাধামি হয়ে যাবে, ভাবল সে। এখানেই আরাম করে বসে থাকতে পারে, শুয়েও থাকতে পারে ইচ্ছে হলে। কাজ যা করার অন্যেরাই করুক না, সে কেন অযথা খাটতে যাবে? দরজাটা আটকে গেছে, বেরোতে পারেনি, এটা তার দোষ নয়। দরজা খোলার। চেষ্টা বাদ দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল দেয়ালে।
বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়। মস্ত ঢেউটা সরে যাওয়ার পর, বাতাস আসার আগে, মাঝখানে একটু সময় পেয়েছে রবিন। নেমে চলে এসেছে কাকের বাসা থেকে। কাত হয়ে শুয়ে আছে যেন শুকতারা, বাতাসের দিকে পিঠ দিয়ে। কাত হয়ে আছে ডেক, টিনের ঘরে চালার মত। গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে না। যেন শক্তহাতে ধরে রাখা হয়েছে জাহাজটাকে। পানি আগের মতই মর্সণ। তবে বাতাস আসার পর থাকবে এরকম। লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
প্রাণপণে লড়ে চলেছে দুর্বল ইঞ্জিন। ঢেউয়ের চূড়া পেরিয়ে এসে আরেক পাশের ঢালে রয়েছে এখন জাহাজ। নিচ দিয়ে ঢেউটা গড়িয়ে সরে যাওয়ার পর সোজা হল। কিন্তু হয়েও সারতে পারল না, ঝাপটা মারল বাতাস।
রবিনের মনে হল, বাতাস নয়, ইটের দেয়াল এসে ধাক্কা মারল তাকে। বাতাসের মুখোমুখি হয়ে আছে সে। আপনাআপনি বুজে গেছে চোখের পাতা, জোর করে বাতাস ঢুকে গেছে ফুসফুসে, ফোলাতে ফোলাতে যেন ফাটিয়ে ফেলবে। এখনই মাস্তুলের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলতে না পারলে একটা পাতার মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাকে হাওয়া। শুধু হাত দিয়ে মাস্তুল আঁকড়ে ধরে রেখে বাঁচতে পারবে না।
ঝড় আরও দেখেছে সে, কিন্তু এমন অবস্থা দেখেনি। হারিক্যান নামটা কোথা থেকে এসেছে, জানে। বই পড়ে জেনেছে। নামটা এসেছে মধ্য আমেরিকার ইনডিয়ানদের বজ-বিদ্যুতের অপদেবতা হারাকান থেকে। এই একই ঝড়কে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম অঞ্চলের লোকেরা বলে টাইফুন, নামটার উৎপত্তি চীনা শব্দ টাইফুং, অর্থাৎ প্রচণ্ড বাতাস থেকে। আরও অনেক নাম আছে এই ঝড়ের। কেউ বলে চাব্যাসকো, কেউ সিক্লোন, কেউ হারাকান। বলে টরবেলিনো, টরমেনটা, কিংবা ট্রপিক্যাল। কিন্তু যে যে নামেই ডাকুক, একবার যে এর মধ্যে পড়েছে, জীবনে ভুলবে না আর।
মাস্তুলের একদিক থেকে ঘুরে আরেক দিকে চলে এল রবিন। শ্বাস নিতে কষ্ট হল এভাবেও।
জাহাজের সামনের পাটাতনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানি। সেখান থেকে খানিকটা খাবলা মেরে তুলে পেছনে ছিটিয়ে দিল বাতাস। তালু ছড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাসের জোর পরীক্ষা করতে গিয়েছিল রবিন, প্রচণ্ড ঝটকায় হাত সরে গেল পেছনে। হাতের তালুতে পানির কণা সুচের মত এসে বিঁধে রক্তাক্ত করে ফেলল চামড়া। অবশ হয়ে গেল হাতটা, যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। আন্দাজ করল সে, ঘন্টায় দেড়শো মাইলের কম হবে না বাতাসের গতিবেগ।
বিশাল ঢেউটা যাওয়ার পর যে শান্ত হয়ে গিয়েছিল সাগর, এই বাতাসে সেটা আর থাকতে দিল না। জ্যান্ত হয়ে উঠল যেন পানি। লাফিয়ে উঠতে লাগল বড় বড় ঢেউ। কয়েক মুহূর্ত শান্ত হয়ে ছিল জাহাজটা, এখন পাগলের মত নাচতে শুরু, করল ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে। ঢেউয়ের মাথায় ওঠার সময় ওঠে নাক উঁচু করে, নামার। সময় নামে নিচু করে, বিপজ্জনক ভঙ্গিতে।