পার্ল অ্যাটলে ওরা তিন গোয়েন্দার সঙ্গে না গেলেই খুশি হত সে। কিন্তু ওদেরকে ছাড়া, কিংবা দক্ষ অন্য কোন নাবিকের সহায়তা ছাড়া যেতে পারবে না কিছুতেই।
পারবে, যদি সে নিজে নাবিক হতে পারে, নেভিগেশন শিখে নিতে পারে। সূর্য, তারা, আর ক্রনোমিটারের সাহায্যে জাহাজের গতিপথ নির্ধারণ করা জানতে হবে। হিসেবে সামান্যতম ভুল করা চলবে না। তাহলেই চলে যাবে একদিক থেকে আরেক দিকে, আসল জায়গায় যাওয়া আর হবে না।
বুদ্ধি আছে তার। চেষ্টা করলে শিখতে পারবে না তা নয়, বরং অন্য অনেকের চেয়ে দ্রুতই পারবে। কিন্তু আরও একটা সমস্যা রয়ে যায়, কলিগ আর জামবুকে কোথায় নামিয়ে রেখে যাবে? কিভাবে? কি বলে বোঝাবে…
ভাবনায় বাধা দিল কলিগ, কি ভাবছ?
সূর্যটা ধরতে পারছি না ঠিকমত।
ওপরে তাকাল কলিগ। সূর্য যেখানে থাকার কথা, সেখানে শুধু একটা সাদাটে আভা। আকাশের কালো ভূতুড়ে মুখটা অন্ধকার হচ্ছে আরও।
ব্যারোমিটার দেখল ক্যাপ্টেন। সাধারণত তিরিশের ওপরে থাকে, এখন উনত্রিশের কাছাকাছি নেমে এসেছে।
মনে হচ্ছে, বড় রকমের বাড়ি খাব, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কলিগ। মন্তব্যটা অদ্ভুত লাগল কিশোরের কাছে। তার ধারণা ছিল বাতাস বাড়বে, তা হয়ে কমছে। খুব সামান্য, ঝিরঝির করে আসে, যায়, আসে, যায়। স্কুলে পড়েছে পাল। প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে হাওয়া।
ঘটনাটা কি? কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে মুসা। ঘুমাচ্ছিল। আগের দিন অক্টোপাসের সঙ্গে লড়াইয়ের পর বিশ্রাম দিচ্ছিল শরীরটাকে। সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ, অক্টোপাসের সাকশন কাপের শোষণের স্বাক্ষর। শ্বাসই নিতে পারছি না!
বিশাল এক কম্বল ছড়িয়ে দিয়ে যেন চেপে ধরা হয়েছে শুকতারার যাত্রীদের, শ্বাসরুদ্ধ করে মারার পায়তারা চলছে।
হারিক্যান! ঘোষণা করল কলিগ। কুমালো, আলগা যা যা আছে, শক্ত করে বাঁধ। জামবু, পাল খোল। প্রধান মাস্তুলের নিচে গিয়ে দাঁড়াল সে। আরে, বাবা, একটু জলদি কর না! হাত চালাও। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে, তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে। এই তোমরাও এস, ধর, ধর! আর সময় নেই!
তাড়াহুড়ো করে নামাতে গিয়ে, পুলিতে দড়ি পেঁচিয়ে আটকে গেল একটা পালের ওপরের দিকটা।
ইসসিরে, আর সময় পেল না আটকানোর! উঠে গিয়ে এখন খুলতে হবে, উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে ক্যাপ্টেন। মাল্লাদের দিকে তাকাল। কুমালো আর জামবু দুজনেই ব্যস্ত। সে নিজে বয়স্ক লোক, ভারি শরীর, মাস্তুল বেয়ে এত ওপরে উঠতে পারবে না। মুসা পারবে, কিন্তু ঘষা লাগলেই চাকা দাগগুলোতে ব্যথা পায়।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল রবিন। সারা দিনে কয়েকবার করে কাকের বাসায় উঠে উঠে মাস্তুল বাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে তার। বেয়ে উঠতে শুরু করল আরেকবার। নিচের দিকের ক্রসট্রীগুলো পেরিয়ে উঠল কাকের বাসায়। জিরানোর সময় নেই। উঠে গেল আগায়। পুলি থেকে দড়ির জট ছাড়িয়ে দিতেই হড় হড় করে নামতে শুরু করল পাল।
ডেকে তখন তুমুল ব্যস্ততা। দড়ি দিয়ে হ্যাচের মুখগুলো বেঁধে ফেলেছে কুমালো, ডিঙি বাঁধছে। অক্টোপাসের ট্যাংকটা জায়গামত আটকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে জাহাজের দুলুনির সময় না নড়ে! ছোটবড় সব কটা ট্যাংকের ঢাকনা শক্ত করে লাগাতে হবে। ইচ্ছে করলে খুবই দ্রুত কাজ করতে পারে জামবু, কিন্তু তাকে কেউ কিছু করার আদেশ দিলেই চিটাগুড়ের মত আঠা হয়ে যায় যেন তার শরীর, নড়তেই চায় না আর। কয়েকটা পাল গুটিয়ে নিয়ে নিচের তলায় রাখতে এল। স্টোররুমে ঢুকেই যেন আর কাজ পেল না, এই জরুরি মুহূর্তে মদ খাবার ইচ্ছে হল।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ক্যাপ্টেন। বিপদের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে সবরকমে তৈরি করছে জাহাজটাকে।
পালে হাওয়া লাগলে সহজেই সাড়া দেয় শুকতারা, কিন্তু ইঞ্জিনের সঙ্গে সমঝোতা হতে সময় লাগল। সাড়া দিতে সবে শুরু করেছে। ঠিক এই সময় এল ঝড়।
মাস্তুলের ওপরে থেকে আসতে দেখল প্রথম রবিন। ডেকে নামার সুযোগ পেল না। কাকের বাসায় মাস্তুল আঁকড়ে বসে থাকতে বাধ্য হল সে।
বিশাল এক ঢেউ, তার মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেক ওপরে। একটা মাত্র ঢেউ, আসার কোন ইঙ্গিতই দেয়নি, জন্মাল কখন তা-ও বোঝা যায়নি। হঠাৎ চোখে পড়ল ঢেউটা, পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে গেছে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল রবিন। ঢেউয়ের চূড়ায় সাদা ফেনা নাচছে। দেখে মনে হচ্ছে সাগরের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক নেই ঢেউটার, পানি আর আকাশের মাঝে শূন্যে ঝুলে ঝুলে ছুটে আসছে শুকতারাকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যে।
ঢেউয়ের দিকে পাশ ফিরিয়ে আছে জাহাজ। ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করল পাহাড়ে। পানির ঢলে পড়ে কাত হয়ে যাচ্ছে। এত বেশি কাত হয়ে গেল মাস্তুল, নিচে তাকিয়ে ডেক দেখতে পেল না রবিন, চোখে পড়ল আয়নার মত চকচকে সাগর।
হাত ছেড়ে লাফিয়ে পড়বে পানিতে? তার মনে হল, এই ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সাধ্য দুনিয়ার কোন জাহাজের নেই, এখুনি উল্টে যাবে শুকতারা। তখন আর মুক্তির উপায় থাকবে না। পানির তলায় চলে যাবে সে।
কিন্তু কি ভেবে শেষ পর্যন্ত ছাড়ল না রবিন। কুঁচকে ফেলল নাকমুখ, যখন ঢেউয়ের চূড়াটাকে তার ওপর ভেঙে পড়তে দেখল। পনি এরকম আঘাত করতে পারে, জানতই না সে। মনে হল কঠিন কিছু দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে তাকে। পানির চাপে কাকের বাসার রেলিঙ আর মাস্তুলের সঙ্গে এমনভাবে আটকে গেল, চাইলেও এখন আর নিজেকে ছোটাতে পারবে না।