মরে গেল নাকি ব্যাটা! শঙ্কিত হল মুসা। কুমালো বলেছে, জোরে এক কামড় দিয়েই মেরে ফেলা যায় এতবড় দানবকেও। বিন্দুমাত্র নড়ছে না ওটা। মরেই গেছে। বোধহয়!
দম নিয়ে ডুব দিল মুসা। একটা শুড় ধরে অক্টোপাসটাকে টেনে নিয়ে চলল গুহার বাইরে। শুড়-টুড় মিলিয়ে আকারে বিশাল হলেও ওজন ততটা নয়। তাছাড়া পানির নিচে হওয়ায় ভার আরও কমে গেছে। হাড়ও নেই শরীরে, শুধু ঠোঁটটা ছাড়া।
গুহার বাইরে বেরিয়ে তবে স্বস্তি। উজ্জ্বল রোদে আলোকিতপানি। পৃথিবীটাকে আর এত সুন্দর মনে হয়নি কখনও মুসার। আধ ঘন্টা আগে যা ছিল, তার চেয়ে অনেক জ্ঞানী মনে হচ্ছে এখন নিজেকে। কারণ খানিক আগে মৃত্যুর করাল রূপ দেখে এসেছে সে। বুঝেছে, মৃত্যু কত ভয়ঙ্কর, বেঁচে থাকা কতটা আনন্দের।
পানির ওপরে মাথা তুলল সে। ধারেকাছে কেউ নেই। সবাই দূরে। চেঁচিয়ে ডাকল সে। ফিরে তাকাল ওরা। দুহাতে তুলে ধরে একটা শুড় নাচাল মুসা। থমকে দাঁড়াল সবাই, তারপরই দৌড় দিল এদিকে।
সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কাকে ধরেছ! মরা নাকি?
মনে হয় না। জাহাজে তোলা যায় কিভাবে?
তুলো না তুলো না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল কুমালো। পানির ওপরে তুললে রোদ লাগলেই মরে যাবে।
নৌকা আনতে গেল কুমালো। এই সময়ে সবাইকে তার কাহিনী শোনাতে লাগল মুসা। শুনতে শুনতে ফ্যাকাসে হয়ে গেল কিশোর আর রবিনের চেহারা। আর জামবুর চোখ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে।
যাক, খুশি হলাম, ক্যাপ্টেন কলিগ বলল। দুষ্টুমি করে বটে। সাহসও আছে। এরকম ছেলেই আমার পছন্দ।
দাড় বেয়ে নৌকা নিয়ে হাজির হল কুমালো। বলল, শুড় ধরে বসে থাক কোয়। টেনে নিয়ে যাব। দেখ, পানির ওপরে না ভেসে ওঠে।
জাহাজের কিনারে ভিড়ল নৌকা। দড়ি নামিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা হল তুলতুলে শরীরটা। তারপর যত তাড়াতাড়ি পারা গেল চালান করে দেয়া হল ট্যাংকে, যতটা সল্ক রোদ বাঁচিয়ে।
ট্যাংকটা ছোট হয়ে গেল অক্টোপাসের জন্যে। শরীরটা ঠিকই আঁটে, গুঁড়গুলো। বেশি লম্বা। সোজা করা যায় না ট্যাংকের ভেতরে। বারো ফুট লম্বা একেকটা।,
কুমালো বলল, সোজা করার দরকার নেই। করে না সাধারণত। গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে।
হুঁশ ফিরছে দানবের। আলো দেখা দিল চোখ দুটোয়। শুরু হল সারা শরীরে রঙের খেলা। কিলবিল করে উঠল শুড়গুলো।
পানি খেয়ে ফুলছে বস্তা-শরীর। হঠাৎ লাফ দিল ওটা, বাড়ি খেল গিয়ে আরেক পাশের দেয়ালে। আবার লাফ দিল আরেক পাশে, বাড়ি খেল এবারও। বুঝল আটকা পড়েছে। ট্যাংকের ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করল পাগলের মত প্রচণ্ড রাগে শেষে শুড় কামড়াতে শুরু করল।
বেশি রেগে গেলে ওরকম করে ওরা, কলিগ জানাল ধরা পড়লে কামড়ে নিজের শুড়ই খেয়ে ফেলে। শুড়-ছাড়া-অক্টোপাস বেচতে পারবে কাস্টোমারের কাছে?
শঙ্কিত হয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা। এত কষ্ট করে ধরে এনে তাহলে লাভটা কি, শুড়ই যদি খেয়ে ফেলে?
সমস্যার সমাধান করে দিল কুমালো। বড় দেখে একটা লোহার ড্রাম এনে রাখল ট্যাংকের ভেতর, কাত করে। খোলা মুখটা রইল অক্টোপাশের দিকে।
নিমেষে রাগ দূর হয়ে গেল দানবটার। সুড়ুৎ করে গিয়ে ঢুকে পড়ল ড্রামের ভেতরে। শুড়গুলো ভেতরে গুটিয়ে নিল, যতটা জায়গা হল।
সাগরের নিচে, কুমালো বলল। অন্ধকার গর্তে বাস করে ওরা। গর্তে ঢুকলে নিরাপদ মনে করে। আর গণ্ডগোল করবে না। বাড়ি পেয়ে গেছে।
৮
ভোর থেকেই উত্তেজিত হয়ে আছে শুকতারার যাত্রীরা। অস্বস্তিতে ভুগছে।
বিকিনি ছেড়েছে শুকতারা। এগিয়ে চলেছে পোনাপের দিকে। চমৎকার হাওয়া লাগছে পালে, সাগর শান্ত, অস্বস্তি বোধ করার কারণ নেই। তবুও করছে
ওরা,কারণ, বাতাস গরম। অসহ্য। বাষ্প মিশে রয়েছে যেন বাতাসের সঙ্গে।
নিষ্প্রাণ এই বাতাসে শ্বাস নিয়েও শান্তি নেই। বমি বমি লাগে। আকাশও নীল নয়। কেমন যেন কালচে-সাদা।
একই সাথে একটা বিশেষ কিছুর রঙ কালো আর সাদা হতে পারে না, অথচ আকাশের বেলায় তাই হয়েছে। ফ্যাকাসে কালো অন্ধকার ধীরে ধীরে চেপে আসছে যেন জাহাজের ওপর, মলিন করে দিয়েছে সবার মুখ। বেলা বাজে বারোটা, অথচ দেখে মনে হয় কাকডাকা ভোর।
বিনাকলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। হাতে সেক্সট্যান্ট। দুপুরের রীডিং নেয়ার চেষ্টা করছে। তাহলে নটিক্যাল অ্যালম্যানাকের সাহায্য নিয়ে জাহাজের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে।
খুব আগ্রহ নিয়ে ক্যাপ্টেন কলিগের কাছে নেভিগেশন শিখছে কিশোর। যেকোন কাজ জানা থাকলে অনেক সুবিধে। আর এটা জানা তো এখন তিন গোয়েন্দার জন্যে বিশেষ জরুরি, কারণ, প্রফেসর ইস্টউডের গোপন মুক্তার খামারে যেতে হবে। কখন কি ঘটে যায়, ঠিক আছে?
মনে যেন জুলজুলে অক্ষরে লেখা হয়ে আছে পজিশনটাঃ নর্থ ল্যাটিচিউড এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট, ইস্ট লংগিচিউড একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট।
একটা সমস্যার সমাধান এখনও করতে পারেনি সে। আসল অবস্থানের কথা কাউকে না জানিয়ে কি করে সেখানে পৌঁছবে? সঙ্গে যে-ই যাক, জেনে যাবে, জামবু, কুমালো, কলিগ, তিনজনেই।
কুমালোকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন আর জামবুকে? প্রফেসরকে হুমকি দিয়েছে যারা, চুরি করে ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছে, তাদের সঙ্গে কি যোগাযোগ আছে দুজনের? কি করে জানা যাবে? ওদের কিছু কিছু মন্তব্য সন্দেহ জাগিয়েছে তার মনে।