সুড়ঙ্গের এপাশে থেকে ওপাশে ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছে মুসা, পলকের জন্যে মাঝে মাঝে শুধু চোখে পড়ছে পাখনা কিংবা শুড় নড়ানো। দৃষ্টি আরও অচল হয়ে গেল, যখন কালির থলে থেকে একরাশ কালো কালি ছুঁড়ে মারল অক্টোপাস। পানিতে কালো মেঘের মত ছড়িয়ে পড়ল কালি।
এখন বাইরে বেরোনো আত্মহত্যার সামিল। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে মুসা। প্রার্থনা করছেঃ আল্লাহ্, সরে যাক ব্যাটারা, খালি একটু দূরে সরুক! আমি বেরোতে পারলেই হয়! আল্লাহ…
আবার চেঁচাতে শুরু করল সে। কাছাকাছি কি কেউ নেই নাকি? ভয়াবহ লড়াই চোখে পড়ছে না কারও? পানিতে ওই আলোড়ন দেখতে পাচ্ছে না?
পানিতে এখন কালি গোলা। কিছু দেখতে পাচ্ছে না মুসা। দানব দুটো আছে না গেছে, বোঝার উপায় নেই।
ঠিক করল সে, ঝুঁকি নেবে। লম্বা দম নিয়ে ডুব দিল। কিন্তু ফিরে এসে ভেসে উঠতে বাধা হল আবার। কারণ, সুড়ঙ্গমুখে চকিতের জন্যে আবছাভাবে চোখে পড়েছে বস্তা-শরীরের মুখ। ওপাশের কালো মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
একা। তাড়িয়ে দিয়ে এসেছে শত্রুকে। আট পায়ে ভর দিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাঁটছে গুহার মেঝেতে, বিরাট এক মাকড়সার মত।
শিকারের দিকে তাকিয়ে নাচ জুড়েছে যেন। আটকা পড়া ইঁদুরকে ধরার আগে ঠিক এরকম ভাবভঙ্গিই করে বেড়াল। সারা শরীরে ওটার এখন রামধনুর সাত রঙ। কুমালো আর কলিগের কাছে জেনেছে মুসা, খুব বেশি রাগলে শরীরের রঙ ওরকম হয়ে যায় অক্টোপাসের।
আবেগ বোঝার ক্ষমতা আছে এদের। বাচ্চাকে কাছে টেনে আদর করে, শত্রু দেখলে খেপে যায়। মাছের চেয়ে অক্টোপাসের মগজ অনেক উন্নত। মানুষের মত চোখ, আর শেয়ালের মত ধূর্ত।
আবার ফুলতে শুরু করেছে ওটা। আবার চিৎকার করে সাহায্যের আবেদন জানাল মুসা। বুঝতে পারছে, সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর বড় জোর কয়েক সেকেণ্ড।
তীব্র গতিতে পানি বেরোতে লাগল বস্তার ভেতর থেকে। ছুটে এল অক্টোপাস। জড়িয়ে ধরল শিকারকে।
অন্য কেউ হলে হয়ত হাল ছেড়ে দিত এতক্ষণে, কিন্তু মুসা ছাড়ার পাত্র নয়। মরতে হলে লড়াই করে মরবে। দ্রুত ভাবনা চলেছে মাথায়। অক্টোপাসের ব্যাপারে আর কি কি বলেছিল কুমালো? সাগরের এই আতঙ্ককে খালি হাতে লড়াই করেই অনেক সময় হারিয়ে দেয় দ্বীপবাসীরা। দুই চোখের মাঝখানে রয়েছে এদের সব চেয়ে দুর্বল জায়গা, একটা বিশেষ নার্ভ সেন্টার। ওখানে আঘাত লাগলে অবশ হয়ে যায় অক্টোপাসের শরীর।
আশা হল মুসার। শুধু হারানোই নয়, এই দানবটাকে জ্যান্তই ধরে নিয়ে যেতে পারবে হয়ত সে। বড় একটা অক্টোপাস চেয়েছেন মিস্টার লিসটার। কিশোরও খুশি হবে, মুসার ওপর থেকে রাগ কমবে তার।
প্রবাল আঁকড়ে ধরে পানির ওপরে মাথা তুলে রাখল মুসা, যতক্ষণ পারল। শ্বাস টানল জোরে জোরে। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে পানির নিচে নামিয়ে নেয়া হল তাকে। কিন্তু এখন আর আগের মত আতঙ্কিত নয় মুসা। ফুসফুসে বাতাস ভর্তি, মনে দুর্জয় সাহস। এখন তাকে দেখলে ভাবতেই পারবে না কেউ, এই সেই মুসা আমান, ভূতের নাম শুনলেই যে ভয়ে কাবু হয়ে যায়। শরীর থেকে শুড় ছাড়ানোর জন্যে এখন আর ধস্তাধস্তি করছে না সে। কাজ হয় না, তাতে শক্তিই খরচ হয় অহেতুক।
ধীরে ধীরে তাকে কাছে টেনে নিচ্ছে অক্টোপাস। শয়তানি ভরা চোখ দুটোর কাছে, আরও কাছে। আফ্রিকায় রেগে যাওয়া গণ্ডার দেখেছে মুসা। গণ্ডারের কুতকুতে চোখের চাহনির সঙ্গে অক্টোপাসের চাহনির অনেক মিল।
এতক্ষণ বস্তা-শরীরের ভেতরে লুকিয়ে ছিল অক্টোপাসের চোয়াল দুটো। বেরিয়ে এল এখন। তোতাপাখির ঠোঁটের মত বাঁকা, কিন্তু অনেক অনেক বড়। প্রচণ্ড শক্তি ওই চোয়ালের, এক চাপ দিয়ে পাকা নারিকেল গুঁড়িয়ে ফেলতে পারে। মুসার মাথাটা গুড়ো করতেও এক চাপের বেশি লাগবে না।
তবু নড়ছে না মুসা।
এমন ভাব দেখাচ্ছে, দুর্বল হয়ে গিয়ে নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সে। দানবটাকে বোঝাতে হবে, হাল ছেড়ে দিয়েছে। ততো শক্ত করে আর তাকে, ধরেনি অক্টোপাসটা, ধরার দরকার মনে করছে না। এটার ওপর এত বল প্রয়োগ করে লাভ নেই। খাবারকে আস্তে আস্তে মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে শুড়গুলো।
দম ফুরিয়ে এসেছে মুসার। বাতাসের জন্যে আকুলি বিকুলি করছে ফুসফুস। কিন্তু চুপ করে রইল সে। জায়গাটা কোথায়? কুমালো বলেছে, দুচোখের মাঝখানে, শরীরের সমস্ত স্নায়ু ওখানে এক জায়গায় মিলিত হয়ে একটা গুটি তৈরি করেছে, মটরদানার সমান।
হ্যাঁ, আছে, ওই তো! উঁচু হয়ে আছে, ছোট্ট ফেঁড়ার মত। মন শক্ত করল মুসা। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে কুতকুতে চোখ দুটো। তার মনের কথা বুঝে ফেলছে না তো? পেশী ঢিল করে দিল সে।
অক্টোপাসটাও চাপ আরও কমাল। এইই সুযোগ। হঠাৎ সামনে ঝাঁপ দিল সে। দানবটার মাথা খামচে ধরে কামড় বসালো ফোঁড়াটায়।
যন্ত্রণায় মানুষের মত গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস। দুর্বল ভঙ্গিতে শরীর ঝাঁকিয়ে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করল। কালি দিয়ে কালো করে ফেলল পানি। নিয়ন্ত্রণ হারাল সাকশন কাপগুলো। মুসার শরীর থেকে খসে পড়ল সব কটা শুড়।
কামড় ছাড়ল না মুসা। চাপ দিল আরেকটু জোরে। আবার গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস। ধস্তাধস্তি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।
আর থাকতে পারছে না মুসা। এখুনি দম নিতে না পারলে ফেটে যাবে যেন ফুসফুস। অক্টোপাসটাকে ছেড়ে পানির ওপর ভেসে উঠল সে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ ভেসে থেকে বিশ্রাম নিল। নিচে, পানিতে নিথর হয়ে ঝুলে রয়েছে দানবটা।