ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। আশেপাশের রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে ঘাপটি মেরে রয়েছে ওটা, শিকারের জন্যে ওত পেতেছে। বিশাল এক অক্টোপাস!
অবাক নয় সে, আতঙ্কিত। বোঝা উচিত ছিল, অল্প পানিতে যখন অসংখ্য বাচ্চা রয়েছে, বুড়োটাও রয়েছে কাছাকাছি কোঞ্চও। কল্পনাই করেনি গুহার মধ্যে বসে আছে ওটা।
আস্তে ভেসে উঠে ফুসফুস ভর্তি করে বাতাস নিল মুসা। জানে, সময়মত বেরোতে না পারলে, জানোয়ারটার সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লে অক্সিজেন দরকার হবে। পানিতে সামান্যতম আলোড়ন না তুলে আবার ডুব দিল সে। সোজা এগোল সুড়ঙ্গের দিকে। সরে যাচ্ছে…যাচ্ছে…আর একবার পা নাড়া, তাহলেই ঢুকে যাবে সুড়ঙ্গে…
ঠিক এই সময় আলতো করে তার গোড়ালি জড়িয়ে ধরল কোন কিছু। খুব দ্রভাবে টেনে নেয়া হতে লাগল তাকে গুহার ভেতরে। ছাড়ানোর জন্যে ঝাড়া মারল সে, ছুটতে পারল না। ধরেছে নরমভাবে, কিন্তু বাঁধন ভীষণ শক্ত।
ছুরির জন্যে হাত বাড়াল মুসা। ধক করে উঠল বুক। নেই! মনে পড়ল, প্যান্টের বেল্টে আটকানো রয়েছে ছুরির খাপ, কাপড় খোলার সময় ওটা খুলে রেখে এসেছে সৈকতে।
দুহাতে ধরে তঁড়টা ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। চ্যাপ্টা হুঁড়, পেটের দুই কিনারে দুই সারি সাকশন কাপ। চামড়া থেকে ওগুলোর তীব্র আকর্ষণ ছুটানোর সাধ্য তার হল না। বরং টের পেল, আরেক হুঁড় দিয়ে আরেক পা জড়িয়ে ধরা হচ্ছে, তৃতীয় আরেকটা ঔড় খুঁয়োপোকার মত তিরতির করে হেঁটে যাচ্ছে কাঁধের ওপর দিয়ে।
সাহায্যের জন্যে চিৎকার শুরু করল মুসা। এখন হয়ত তার মাথার ওপরেই রয়েছে সবাই, তার বেরোনোর অপেক্ষা করছে, তাকিয়ে আছে পানির দিকে। তার ডাক ওদের কানে গেলে নিশ্চয় দেখতে আসবে।
চিৎকার করায় অতি মূল্যবান অক্সিজেনের অনেকটাই বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। আর আধ মিনিটের মধ্যে যদি দম নিতে না পারে, জ্ঞান হারাবে। শুড় ছাড়ানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রাণপণে গুহার ওপরে ভেসে উঠতে চাইল সে। দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে থাকা প্রবাল ধরে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করল শরীরটা।
ভারি একটা শুড়ের চাপ রয়েছে কাধে। ওটা কিছুতেই সরাতে পারল না সে। শেষে মরিয়া হয়ে কাধ নিচু করে চোখা প্রবালে ঘষা মারল শুড়টা।
গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস, একেবারে মানুষের মত। কাঁধের ওপর শুড়ের চাপ কমার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়া দিয়ে ওটাকে নামিয়ে দিল মুসা দুই পায়ের বাঁধন আগের মতই রয়েছে। তবু কাধ থেকে শুড়টা সরাতে পারায় ভেসে উঠে দম নেয়া সম্ভব হল।
তারপর শুরু করল চিৎকার। গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল, কিশোর! রবিইন! দোহাই তোমাদের! আমাকে বের কর! অক্টোপাসে ধরেছে!… কুমালোওওও…
চেঁচিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলল সে। কোন সাড়া এল না।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে চাইল তার, ভয়ে। রসিকতা করেছে ওদের সঙ্গে একটু আগে। ওরা হয়ত ভাবছে আবার নতুন কোন রসিকতা। মনে পড়ল সেই মেষ পালকের কথা। বাঘ এসেছে! বাঘ এসেছে! বলে অযথা। চেঁচিয়ে সত্যি সত্যি বাঘ যখন এল কেউ এল না তাকে সাহায্য করতে পায়ে টান লাগল।
কিশোওর! দোহাই তোমাদের! প্রায় কেঁদে ফেলল মুসা। আল্লার কসম, অক্টোপাস…
কথা শেষ করার আগেই টান মেরে পানির তলায় নিয়ে গেল তাকে জীবটা। এগিয়ে এল বাকি গুঁড়গুলোও। এক এক করে জড়িয়ে ধরতে লাগল কাঁধ, বুক, পেট।
আমাজানের জঙ্গলের বোয়া-কনসট্রিকটরের কথা মনে পড়ল। ভয়ঙ্কর সাপ। একেকটা শুড়কে একেকটা সাপ বলে মনে হল এখন, তারমানে মোট আটটা সাপ। একযোগে আক্রমণ করেছে। শক্ত হচ্ছে চাপ, আগের মত আলতো ভাব আর নেই। পেট বসে যাচ্ছে চাপের চোটে, হাঁসাস করছে ফুসফুস, পাগল হয়ে এলোপাতাড়ি বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ড।
ছায়া নামল এই সময় গুহার ভেতরে, সূর্যকে মেঘে ঢেকে দেয়ায় রোদ পড়ে গেল যেন। তারমানে সুড়ঙ্গে ঢুকেছে কেউ, আলো আসায় বাধা পড়েছে। আশার আলো জ্বলল মুসার মনে। নিশ্চয় কুমালো! অনেক কষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, সে, কে এসেছে দেখার জন্যে। কুমালো নয়, সুড়ঙ্গমুখে দেখা দিল মস্ত এক হাঙ্গরের মাথা, টাইগার শার্ক। রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছে সাগরের কসাই। প্রবালের ঘষায় মুসার শরীরের কয়েক জায়গা কেটে রক্ত বেরোচ্ছে।
অনাহূত আগন্তুককে দেখেই রেগে লাল হল অক্টোপাস। ঢিল হল শুড়ের বাঁধন। সত্যি সত্যি লাল রঙ এখন শরীরের।
এমনিতেই ফোলা ঢোল, পানি টেনে নিয়ে আরও ফুলে পিপা হয়ে যেতে লাগল বস্তার মত শরীরটা। হঠাৎ বেরিয়ে গেল টেনে নেয়া সমস্ত পানি, শত্রুর দিকে টর্পেডোর মত ছুটে গেল অক্টোপাস। এত জোরে গেল, ওটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হেরে গেল মুসার দৃষ্টি।
জেট প্লেন বা রকেটের সঙ্গেই শুধু তুলনা করা চলে ওই গতিকে। ব্যতিক্রম শুধু, ওগুলোর পেছনের ফুটো দিয়ে বেরোয় গ্যাস, আর এটার বেরোল পানি। শুড়গুলো লম্বা হয়ে ছুটে গেল বস্তাশরীরের পেছনে, যেন ধূমকেতুর পেছনে তার ছড়ানো ফোলা লেজ।
আটটা শুড়ের শতশত সাকশন কাপ দিয়ে কষে চড় লাগাল অক্টোপাস বেহায়া মাছের গায়ে যত্রতত্র। ব্যাটা, আমার শিকার ছিনিয়ে নিতে আস! এত্তো সাহস! বেরিয়ে গেল হাঙর। ছাড়ল না অক্টোপাস। সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়েই রুখে দাঁড়াল বাঘা হাঙরের বাচ্চা, সে-ও কম শক্তিশালী নয়। গুহার ভেতরে জায়গা কম, নড়তে চড়তে অসুবিধে, তাই বের করে নিয়ে গেছে অক্টোপাসটাকে।