দেখে হাসল রবিন আর কিশোর কুমালো, জামবু আর ক্যাপ্টেনকে নিয়ে প্রবাল প্রাচীরের কিনার ধরে হেঁটে চলল ওরা।
চলতে চলতে থেকে থেকেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কিশোর। উঁকি দিয়ে দেখছে পানিতে। ধরার মত কিছু মেলে কিনা দেখছে। অল্প পানিতে একটা অক্টোপাসের বাচ্চা চোখে পড়ল। আরেকটা। তারপর আরেকটা। খুব ছোট ছোট, বাসনের সমান। কয়েকটা ধরল কুমালো। জানাল, খেতে নাকি দারুণ লাগে, বিশেষ করে অক্টোপাসের শুড়ের কাবাব।
মুসা ওদিকে শুরু করেছে তুমুল দাপাদাপি। ডুবছে, ভাসছে। দেখলে এখন মনে হবে পানিরই ছেলে সে, পানিতে তার ঘর। কয়েকবার ডুবে, ভেসে শরীরটাকে গরম করে নিয়ে সাঁতরে চলে এল অপেক্ষাকৃত গভীর পানিতে। খাড়া ডুব দিয়ে চলে এল বারো-তেরো ফুট নিচে। চোখ দিয়ে যেন গিলছে প্রবালের। অপূর্ব রূপ। পানির নিচ দিয়েই সাঁতরে চলে এল দেয়ালের কাছে। ভাসল। লম্বা দম। নিয়ে আবার ডুব দিল।
দেয়ালের এক জায়গায় একটা ফোকর চোখে পড়ল। ঢুকে পড়ল ওটার ভেতরে। একটা সুড়ঙ্গ। ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে সাঁতরে চলে এল পানির তলার একটা গুহায়। সূর্যের আলো এসে পড়েছে প্রবালের গায়ে, প্রতিফলিত হয়ে মিষ্টি কোমল নীল আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে গুহাটা। এই সৌন্দর্য বর্ণনা করা কঠিন, যেন এক পরীর রাজ্যে চলে এসেছে সে। অসাধারণ শিল্পীর পরিচয় রেখেছে এখানে। প্রবালকীট। দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে ওদের রঙিন শিল্পকর্ম। শুধু রঙ আর রঙ, নীলসাদা, গোলাপী, সবুজ, চোখ জুড়িয়ে যায়।
দম ফুরিয়ে আসছে। পরীর বাগান দেখার জন্যে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না মুসা। সাঁতরে বেরিয়ে আসতে যাবে, এই সময় লক্ষ্য করল, ছাতটা পানির ওপরে। মাঝে ফাঁকা। তারমানে বাতাস আছে। না-ও থাকতে পারে, একথাটা একবারও মনে এল না তার। ভুস করে মাথা তুলল। ফাঁক বেশি না। কাঁধ পর্যন্ত ভাসাতে পারল সে।
হঠাৎ একটা দুষ্টবুদ্ধি মাথাচাড়া দিল মনে। যদি এখন না ফেরে, দেরি করে যায়, কি ঘটবে? সবাই তাকে ডুব দিতে দেখেছে। ভেসে না উঠলে ওরা ভাববে ডুবে মরেছে সে। পানিতে নেমে খোঁজাখুঁজি করবে তাকে। তবে পাওয়ার আশা কম। কারণ সে রয়েছে গুহার ভেতরে।
ওরা যখন তাকে মৃত ধরে নিয়ে হাহুতাশ শুরু করবে, তখন ভাসবে সে। বুঝতে পারবে, সত্যি সত্যি সে মারা গেলে কিশোর, রবিন, কুমালো কে কতটা শোক করবে।
নাক উঁচু করে ভেসে আছে মুসা। সহজেই শ্বাস নিতে পারছে। তারমানে প্রবালের মাঝে সূক্ষ্ম ছিদ্র রয়েছে, অনেকটা স্পঞ্জের মত, সেই ছিদ্রপথে গুহায়। ঢুকছে বাতাস।
ওপরে চেঁচামেচি শুরু হল, গুহায় থেকেই শুনতে পাচ্ছে মুসা। পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার শব্দ হল।
দশ মিনিটের মাথায় লম্বা দম নিয়ে ডুব দিল সে। বেরিয়ে এল গুহা থেকে। ভাসল না। ডুব সাঁতার দিয়ে সরে এল প্রায় বিশ গজ দূরে। পানির কিনারে ওখানে জন্মে আছে একগুচ্ছ নারকেল গাছ। আস্তে পানি থেকে উঠে ওটার ভেতরে ঢুকে বসে রইল সে।
কানে এল কিশোরের কথা, কি করে যে গিয়ে ওর বাবাকে বলব! হায় হায়রে, কেন যেতে দিলাম! কেন মানা করলাম না!
ক্যাপ্টেন বলল, বেচারা! ছেলেটা ভাল ছিল। সত্যি দুঃখ হচ্ছে ওর জন্যে।
রবিন বলল, কেঁদে কেঁদেই মরে যাবে ওর মা!
আমাদের তিন গোয়েন্দাগিরি এখানেই শেষ! আফসোস করল কিশোর। মুসাকে ছাড়া কিছুই করতে পারব না আমরা।
জামবুও দুঃখ প্রকাশ করল। আন্তরিক কিনা বোঝা গেল না যদিও।
কুমালো নেই ওখানে। খানিক পরে উঠে এল পানি থেকে। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছে, মিশনারি মহিলার কাছেই শিখেছে নিশ্চয়। কিশোরের কাঁধে হাত রেখে কাঁদো কাঁদো গলায় সান্ত্বনা দিল, দুঃখ কোরো না। যে মরে গেছে, তার জন্যে আফসোস করতে নেই, তাহলে তার আত্মার অকল্যাণ হয়, পাখিকে শেখানো বুলি ঝাড়ছে যেন। আবার ওর সঙ্গে দেখা হবে আমাদের। স্বর্গে…
আর থাকতে পারল না মুসা। হো হো করে হেসে উঠল। বেরিয়ে এল নারকেল গাছের আড়াল থেকে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। কুমালো হাসল। রবিনও। কিশোর গম্ভীর। শুধু বলল, কাজটা ভাল করনি।
ছিলে কোথায় এতক্ষণ? রবিন জিজ্ঞেস করল। গাছের আড়ালেই?
না, কয়েক মিনিট ধরে আছি। এর আগে পানিতেই ছিলাম।
এতক্ষণ?
বিশ্বাস না হলে আবার দেখ। প্রমাণ করে দিচ্ছি। যতক্ষণ বল ততোক্ষণ পারব।
ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ল মুসা।
আবার গুহায় ঢুকল। মোটা সাপের মত কি যেন একটা পড়ে আছে মেঝেতে। ওটার আরেক মাথা গিয়ে ঢুকেছে গুহার দেয়ালে একটা কালো বড় ফোকরে। শ্বাস নেয়ার জন্যে ভেসে উঠল সে। দম নিয়ে সাপের মত জিনিসটা ভালমত দেখার জন্যে আবার ডুব দিল সে। পরিষ্কার দেখা যায় না। কারণ একটা জিনিসেরই একেক জায়গায় একেক রকম রঙ। পটভূমি, অর্থাৎ যেটার ওপর পড়ে আছে তার যে-রকম রঙ ঠিক সে-রকম। যেখানে প্রবালের রঙ লাল, সেখানে ওটাও লাল, যেখানে নীল সেখানে নীল, সাদা হলে সাদা, কালো জায়গা কালো।
এইসময় একই রকম আরেকটা সাপ চোখে পড়ল তার। তারপর আরও দুটো। সব কটাই গিয়ে ঢুকেছে সেই কালো ফোকরে।
কি আছে কালো গর্তটার ভেতরে? আরও কাছে গিয়ে দেখার পর নজরে পড়ল। কালো গর্তের মতই কালো একটা জিনিসের অর্ধেক বেরিয়ে আছে ফোকরের বাইরে, বাকি অর্ধেক ভেতরে। ফোলা একটা বস্তার মত। দুটো চোখও লাগানো বস্তার গায়ে। ছোট ছোট চোখ, শয়তানি ভরা তির্যক চাহনি, তার দিকেই তাকিয়ে আছে।