কাজটা উচিত করেনি। বাপদাদার জায়গা থেকে তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে। নতুন জায়গায় গিয়ে মানিয়ে নিতে নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়েছে।
খুর। মানাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। রংগারিকে মাছ নেই, ফলের গাছও খুব কম। শেষে বাধ্য হয়ে আমেরিকান নেভির কাছে আবেদন করেছে রাজা, তাদের খাবার ব্যবস্থা করার জন্যে। তাই ওখান থেকেও সরাতে হয়েছে ওদেরকে, উজিলং আইল্যাণ্ডে।
এখন তাহলে ওখানেই আছে?
আছে। তবে সুখী নয়। তাদের শত শত বছরের পুরানো জীবনধারা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। উজিলাংও এখানকার তুলনায় ভাল না। খাবারের জন্যে তাদের নির্ভর করতে হয় আমেরিকান নেভির ওপর। ফলে জীবনের ওপরই ঘেন্না ধরে গেছে ওদের।
দুঃখজনক। বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকেই অনেক শয়তানী করেছে। এখনও কি কোন পরীক্ষা চলছে নাকি এখানে?
বলা কঠিন। তবে এখন বেশি পরীক্ষা চলছে এনিউইটক অ্যাটলে, এখান থেকে দুশো মাইল পশ্চিমে। ওটার পাশ দিয়েই যাব আমরা।
ওখানকার আদিবাসীদেরও নিশ্চয় দেয়া হয়েছে?
হয়েছে। একশো সাতচল্লিশ জন। নীল চোখের চারপাশে রোদে পোড়া চামড়া হাসিতে বঁচকে গেল ক্যাপ্টেনের। আরি, কেঁদে ফেলবে নাকি! সাধারণ কয়েকটা কানাকা। সব সময়ই শাসন করা হয়েছে ওদের, ভবিষ্যতেও করা হবে।
ভারতবর্ষ আর আফ্রিকায় ইংরেজ শাসনের ইতিহাস মনে পড়ল কিশোরের। কঠিন একটা কথা চলে এসেছিল মুখে, অনেক কষ্টে সামলাল।
ডিঙি নামিয়ে তীরে উঠল সবাই। অনেক দিন পর পায়ের তলায় মাটি বেশ ভাল লাগল। দ্বীপ না বলে ওটাকে চমৎকার একটা বাগান বলা উচিত। তেজস্ক্রিয়ায় কোন এক সময়ে গাছপালার ক্ষতি হয়ে থাকলেও এখন তার চিহ্ন নেই। মানুষের ভয়াবহ আঘাত সামলে নিয়েছে প্রকৃতি।
পুরো দ্বীপটা ঘুরে আসতে মাত্র আধঘন্টা সময় লাগল। রাতে খাবার খেল অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে। কিশোর লক্ষ্য করল, বারবার সৈকতে চলে যাচ্ছে কুমালো, কি জানি, বোধহয় ল্যাগুনে রাতের স্তব্ধ আকাশ ভাল লাগছে। গত কয়দিনে লোকটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে তার। শান্ত, হাসিখুশি। সাহস, ধৈর্য, সবই আছে লোকটার। স্কুনার চালানো দেখেই বোেঝা যায় জাত নাবিক। পছন্দের জায়গায় এসে কেমন লাগছে এখন তার?– খুব জানতে ইচ্ছে হল কিশোরের।
আগুনের ধার থেকে উঠে সৈকতে রওনা হল সে। একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে ল্যাগুনের দিকে তাকিয়ে আছে কুমালো। পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর, কিন্তু নীরবতা ভাঙতে ইচ্ছে হল না। চুপ করে রইল।
ল্যাগুনটা এখন কালো। দিনে ছিল সবুজ, এখনকালো আয়নার মত। তাতে আকাশের প্রতিবিম্ব। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীলচে-সাদা অভিজিৎ নক্ষত্র, হলদে স্বাতীনক্ষত্র, আগুন-লাল অ্যানটারিস। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই উঠবে সাদার্ন ক্রস, রকিবীচের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট দেখা যাবে এখানে, কারণ বিষুবরেখার কয়েক ডিগ্রি উত্তরে রয়েছে এই বিকিনি।
প্রবাল প্রাচীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের চাপা গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ল্যাগুনের ওপাশে অন্যান্য দ্বীপগুলো সব অন্ধকার।
আমার বাবা একবার এসেছিল এখানে, বহুদিন আগে, কথা বলল কুমালো। শুনেছি, তখন মানুষ থাকত এখানে। দ্বীপে আনন্দ ছিল। এখন নেই।
নিশ্চয় অ্যাটম বোম…
হ্যাঁ…
পাশাপাশি বসল ওরা। এই সময় মুসা আর রবিনও এসে বসল ওখানে।
কুমালো, কিশোর বলল। এত ভাল ইংরেজি কোথায় শিখলে তুমি? এদিকের লোকে তো ভাল ইংরেজি জানে না শুনেছি।
হাসল কুমালো। তারার আবছা আলোতেও চকচক করে উঠল তার সাদা দাঁত। আমার ইংরেজি তোমার পছন্দ হয়েছে? খুশি হলাম। এক আমেরিকান মিশনারি মহিলার কাছে লেখাপড়া শিখেছি। খুব ভাল মানুষ ছিলেন তিনি। যত্ন করে কত কিছু শিখিয়েছেন আমার দেশের লোককে। ভাল বিদেশী খুব কমই যায় ওখানে।
কুমালো কি বলতে চায়, বুঝল কিশোর। ইউরোপিয়ান আর আমেরিকানরা আগে দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলোতে আসত নারকেলের ছোবড়া আর মুক্তার লোভে, করুণা খুব কমই মিলত তাদের কাছে। স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে ওরা ছড়িয়েছে মারাত্মক রোগ, শিখিয়েছে কড়া মদে নেশা করা, খুন করেছে পাইকারি হারে, নির্মমভাবে, কারণ ওদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র।
গত কয়েক দিনে একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেছে সে, ক্যাপ্টেন আর জামবু দেখতে পারে না কুমালোকে। তারমানে ওদের দলে নেই লোকটা। তথ্য বের করার জন্যে বলল, কুমালো, তোমার দেশের কথা বল।
শুনবে! অবাক মনে হল দ্বীপের বাসিন্দা মানুষটাকে। আমাদের কথা শুনবে তুমি?
বল, রবিন বলল।
অনেক কথাই বলল কুমালো। ওদের সমাজের অনেক কিছু জানল ছেলেরা। বন্ধুত্ব পাতানোর অদ্ভুত একটা রীতি রয়েছে ওখানকার দ্বীপগুলোতে। বন্ধুকে বন্ধু বলে না ওরা, বলে রক্তে-পাতানো-ভাই। এক বন্ধুর জন্যে আরেক বন্ধু নির্দ্বিধায় জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
শুনতে শুনতে হঠাৎ বলে উঠল মুসা, কুমালো, আমার সঙ্গে নাম বিনিময় করবে তুমি?
আবেগে গলা রুদ্ধ হয়ে এল কুমালোর। তারার আলোয় দেখা গেল তার বাদামি গালে চিকচিক করছে পানির ধারা, দুগাল বেয়ে নেমেছে অশ্রু। আচমকা বিশাল দুই থাবার মধ্যে চেপে ধরল মুসার একটা হাত। নিশ্চয় করব, মুসা! আমার হৃদয়ে আমি এখন মুসা, তোমার হৃদয়ে তুমি কুমালো। তুমি আমার রক্তেপাতানো-ভাই। একজনের জন্যে আরেকজন দরকার হলে জীবন দিয়ে দেব আমরা। ইতিমধ্যেই সেটা তুমি করতে চেয়েছে নিজের জীবনের পরোয়া না করে হাঙরের মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছ আমাকে।
৭
কয়েক দিন সাগরে কাটিয়েও আশ মিটিয়ে সাঁতার কাটতে পারেনি সাগরপাগল মুসা আমান। প্রথম সুযোগটা পেয়েই তার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না। পরদিন সকালে জামাকাপড় খুলে ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে।