কয়েকবার ঝাড়া দিয়ে অস্বস্তিকর এই জিনিস খুলে ফেলার চেষ্টা করল। তলোয়ার। ব্যর্থ হয়ে শেষে খোঁচা মারতে শুরু করল ট্যাংকের দেয়ালে। লাভ হল না।
এতে আরও রেগে গেল তলোয়ার। চারশো পাউণ্ড শরীরটা নিয়ে বার বার গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল ট্যাংকের দেয়ালে। আঘাতের পর আঘাত হানল তলোয়ার দিয়ে। কিন্তু আগায় গ্লাভস আর থিমবল নিয়ে অস্ত্র এখন বাতিল। দূর, মরুকগে, বলেই যেন সরে এল তলোয়ার। নতুন মাছ ছাড়া হয়েছে ট্যাংকে। মহানন্দে সদ্ব্যবহার শুরু করল সেগুলোর।
ডাঙা! ডাঙা! কাকের বাসা থেকে চেঁচিয়ে বলল কুমালো।
কপালে হাত রেখে ভালমত তাকাল কলিগ। হ্যাঁ, ডাঙাই মনে হচ্ছে।
তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেলল তিন গোয়েন্দা, কিন্তু ডাঙা চোখে পড়ল না ওদের। দেখল অদ্ভুত এক দৃশ্য। একেবারে দিগন্তরেখার কাছে সবুজ, উজ্জ্বল একটুকরো মেঘ। না, মেঘ বলা বোধহয় ঠিক না, বরং বলা উচিত উজ্জ্বল একধরনের সবুজ আভা।
সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের কালে অনেক সময় সবুজ আভা চোখে পড়ে সাগরের আকাশে, কিন্তু এই মাঝ সকালে ওই সবুজ রঙ কিসের?
যেন জ্বলছে রঙটা। একবার মনে হচ্ছে সবুজ আগুনের শিখা, একবার সবুজ মেঘ, তারপর আবার সবুজ পানির ঢেউ। গায়েব হয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে আবার আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে।
ব্যাপারটা কি! তাজ্জব হয়ে দেখছে কিশোর। বুঝতে পারছে না।
কাকের বাসা থেকে নেমে এসেছে কুমালো। কিশোরের বিস্ময় দেখে হাসল। ওটা বিকিনি অ্যাটল। দেখা যাচ্ছে না এখনও, আকাশের ওই সবুজ রঙ দেখে বুঝেছি।
জ্বলছে কেন? আলোর কারসাজি। ধবধবে সাদা বালিতে ঢাকা ওখানকার ল্যাগুনের তলা। রঙিন প্রবাল আছে অনেক। পানির গভীরতাও মাঝে মাঝে খুব কম। সব কিছু মিলিয়ে ওখানকার পানির রঙ হয়ে গেছে হালকা সবুজ, ওটারই ছাপ পড়েছে আকাশে। মরীচিকাও বলতে পার। দ্বীপটা দেখার আগে অন্তত ছসাত ঘন্টা ধরে দেখা যাবে ওই মরীচিকা।
শেষ বিকেলে দিগন্তে উদয় হল বিকিনি। নারকেল বীথির মাথা দেখা যাচ্ছে শুধু, নিচটা এখনও অদৃশ্য। এগিয়ে চলেছে জাহাজ। রেলিঙে দাঁড়িয়ে অ্যাটলের সৌন্দর্য দুচোখ দিয়ে পান করছে যেন তিন গোয়েন্দা। এই প্রথম দেখছে প্রবাল অ্যাটল।
দূর থেকে মনে হয়, মুক্তার একটা হার যেন অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে নীল চাঁদরের বিছানায়। ওটা আর কিছু না, ল্যাগুনকে ঘিরে রাখা বিশাল প্রবাল প্রাচীর। সগর্জনে দেয়ালে আছড়ে পড়ে সাদা ফেনা সৃষ্টি করেছে ঢেউ, কিন্তু দেয়ালের ভেতরে ঢোকার অধিকার আদায় করতে পারছে না কিছুতেই। ভেতরের পানি শান্ত, স্থির, আকাশের রঙের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে। সাগরের মধ্যিখানে যেন দেয়ালে ঘেরা এক মস্ত হ্রদ। কলিগ জানাল ল্যাগুনটা বিরাট, বিশ মাইল চওড়া।
এতবড় প্রাচীরটার স্রষ্টা প্রবাল নামের এক অতি ক্ষুদ্র কীট। বীজ, ফল, উদ্ভিদের চারা ভেসে ভেসে গিয়ে ঠেকেছে ওই প্রাচীরে, আটকে গেছে পচা প্রবাল আর বালিতে। ফলে যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে মোহনীয় সবুজ দ্বীপ। সাদা প্রবাল পাথরের মাঝে ফুটে উঠেছে সবুজ।
এসব দ্বীপের কোনটা খুবই ছোট, বড় জোর ওদের স্কুনারটার সমান। কোন কোনটা আবার বেশ বড়, মাইলখানেক লম্বা। তবে চওড়ায় অনেক কম। সব চেয়ে বড়টাও মাত্র কয়েকশো গজ।
তিনটে জায়গায় ফাঁক আছে দেয়ালে। ওগুলো দিয়ে জাহাজ ঢোকানো সম্ভব। দক্ষিণ-পুবের পথটার দিকে এগিয়ে গেল শুকতারা। ভালই চলছিল, হঠাৎ পড়ে গেল বাতাস। ঘুরে গেল জাহাজের নাক। পাশ থেকে ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে শুরু করল ঢেউ। ভীমগর্জনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গায়ে। দেয়ালের ফাঁক দিয়ে তীব্র গতিতে ঢুকছে জোয়ারের পানি। পরস্পর বিরোধী স্রোতের মাঝে পড়ে প্রায় নাকানিচোবানি খেতে শুরু করল জাহাজটা।
অভিজ্ঞ নাবিক ক্যাপ্টেন কলিগ। দক্ষ হাতে জাহাজের হুইল ধরে ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল শুকতারাকে। পরিশ্রম করতে হল অনেক, কিন্তু নিরাপদেই অবশেষে জাহাজটাকে নিয়ে এল ল্যাগুনের ভেতরে। শান্ত নিথর পানিকে মনে হচ্ছে এক বিশাল সবুজ আয়না। নারকেল গাছে ছাওয়া ছোট্ট একটা দ্বীপের সাদা সৈকত থেকে একরশি দূরে নোঙর ফেলা হল।
গভীর মনোযোগে ক্যাপ্টেনের চার্ট দেখছে কিশোর। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, এই প্রবাল প্রাচীরে দ্বীপ মোট বিশটা। সব চেয়ে কাছেরটার নাম এনিও। তারপরে রয়েছে বিকিনি, অ্যাওমোয়েন, ন্যামু, রুকোজি, এনিরিকু। আরেকটা আছে, নাম উচ্চারণ করতে গেলে চোয়াল ভাঙার অবস্থা—ভোকোরোরাইওরো।
উত্তর-পূর্ব কোণে একটা ক্রসচিহ্ন। ম্যাপে দেখানো ল্যাগুনের ওই জায়গায় আঙুল রেখে কিশোর জিজ্ঞেস করল, এখানে কি?
আণবিক বোমার পরীক্ষা হত ওখানে, জবাব দিল ক্যাপ্টেন। রেডিও অ্যাকটিভিটির ভয় নেই?
নাহ, এখন আর নেই। শেষ পরীক্ষা হয়েছে ঊনিশশো ছেচল্লিশ সালে। তেজস্ক্রিয়তায় ছেয়ে গিয়েছিল তখন সবকিছু, মাটিতে, নারকেলে, এমনকি মাছেও। অনেক পরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে ঘোষণা দিয়েছেন, তেজস্ক্রিয়তা কমে গেছে। এখন আর মানুষের জন্যে তেমন ভয় নেই, যদি বেশিদিন না থাকে এখানে।
স্থানীয় অধিবাসীদের কি হল? পরীক্ষার আগে নিশ্চয় ছিল ওরা?
ছিল, একশো পঁষট্টি জন। তাদের রাজার নাম জুডা। রংগারিক আইল্যাণ্ডে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল ওদের, এখান থেকে একশো তিরিশ মাইল পুবে।