ডিঙি তো নেই, মাছ ধরব কিভাবে? বলেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুসার চোখের তারা। আছে, উপায় আছে!
কিভাবে? রবিন জানতে চাইল। রাতেই দেখবে।
রাতে, ডেকে বসে পালের ওপর টর্চের আলো ফেলে রাখল মুসা। আলো দেখে পাগল হয়ে গেল যেন উড়ুক্কু মাছের দল। একের পর এক এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল মাস্তুলে, পালে। বাড়ি খেয়ে অবশ হয়ে পড়ল কোনটা, কোনটা পাল থেকে গড়িয়ে পড়ল ডেকে। জমাতে শুরু করল মুসা আর কুমালো। মজা পেয়ে রবিন আর কিশোরও হাত লাগাল। দেখতে দেখতে মাছের ছোটখাট একটা স্থূপ দিয়ে ফেলল।
নিশ্চিন্ত হল তিন গোয়েন্দা। খাবারের অভাব হবে না জনাব শয়তানের।
৬
স্বর্গ যে বলে, ভুল বলে না! হাঁ করে তাকিয়ে আছে কিশোর। সৌন্দর্য যেন গিলছে। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে সুন্দর চোখের তারা। ডায়মণ্ড হেড ঘুরে এসেছে। শুকতারা, ওয়াইকিকির ধবধবে সাদা সৈকতের পাশ কাটাচ্ছে। সবুজ নারকেল গুচ্ছ মাথা দোলাচ্ছে বাতাসে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে জানা-অজানা অসংখ্য গাছ। ঘন। নীল সাগরের পানিতে সার্ফিং করছে সাফাররা। সাবোর্ডে টান টান হয়ে আছে। ওদের বাদামি শরীর। বিশালদেহী একেকজন।
হনুলুলু বন্দরে নোঙর ফেলল শুকতারা।
স্বপ্নের জগতে চলে এসেছে যেন ছেলেরা। পৃথিবীতে এত সুন্দর জায়গা থাকতে পারে, ভাবেইনি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারল না ওই স্বর্গে। বড় দেখে ট্যাংক কিনল, তাতে ম্যানটাটাকে ভরে তুলে দিল লস অ্যাঞ্জেলেসগামী একটা স্টীমারে।
হাওয়াইকে যে এত ভাল বলছে ছেলেরা, এটা পছন্দ হল না কুমালোর। কথায় কথায় জানিয়ে দিল, তার বাড়ি যে দ্বীপে, সেটা আরও অনেক ভাল। ছেলেরা যখন বিশ্বাস করতে চাইল না, বিশেষ করে মুসা, রেগে গেল সে। বলল, দাঁড়াও না, গিয়ে নাও আগে। ওখানকার প্রবাল অ্যাটল দেখলে চোখ ফেরাতে পারবে না। ওরকম কোথায় পাবে তোমাদের এই হাওয়াই? চওড়া বাদামি কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাওয়াইকে বুড়ো আঙুল দেখল দক্ষিণ দ্বীপবাসী।
।নতুন আরেকটা ডিঙি কিনে তোলা হল স্কুনারে। তারপর আবার রওনা হল শুকতারা।
মারশাল দ্বীপপুঞ্জের ছোট-বড় অসংখ্য দ্বীপের কাছাকাছি এসে তাজ্জব হয়ে গেল ছেলেরা। জলজ জীবের ছড়াছড়ি এখানকার পানিতে। তাকালেই চোখে পড়ে। জাহাজের পেছন পেছন দল বেঁধে আসছে ডলফিন। শাঁ করে জাহাজের পাশ কাটিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ফিরে আসছে আবার। লং জাম্প দিচ্ছে, হাই জাম্প দিচ্ছে, যেন একেকটা ভড়।
মস্ত এক স্পার্ম তিমি পুরো একটা দিন সঙ্গী হয়ে রইল শুকতারার।
আরেক দিন এল একটা হোয়েল শার্ক বা তিমি-হাঙর, জাতে ওটা হাঙরই, কিন্তু তিমির মত বড়। কুৎসিত চেহারা হলেও জীবটা নিরীহ, সমগোত্রের অন্যান্য প্রজাতির মত রক্তপিশাচ নয়। খেলার ছলে মাঝে মাঝেই এসে ধাক্কা মারল জাহাজের গায়ে।
রবিন জানে, জীবটা নিরীহ। ক্যাপ্টেন কলিগও বার বার বলেছে একথা। কিন্তু চেহারা এমনই বাজে তিমি-হাঙরের, ভুলতে পারেনি সে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। আতঙ্কে চেঁচাতে শুরু করল ঘুমের মধ্যে। জেগে উঠে দেখল ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। বদ্ধ কেবিনে দম বন্ধ হয়ে এল তার। খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে উঠে এল ডেকে।
রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রাতের সাগর দেখছে মুসা। ফিরে তাকাল। কি হল, ঘুম আসছে না?
এসেছিল, হেসে বলল রবিন। তিমি-হাঙরে গিলতে এল, তাই জেগে উঠে পালিয়ে এসেছি।
চকচক করছে রাতের সাগর, যেন একটা রূপালি চাদর। এর কারণ কোটি কোটি প্ল্যাঙ্কটনের সমষ্টি, ওগুলোর শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হয় একধরনের উজ্জ্বল আভা।…
জাহাজের পেছনে জাল বাধাই রয়েছে। তাতে ধরা পড়ছে নানারকম বিচিত্র প্রাণী। বদমেজাজী একটা কংগার ইল ধরা পড়ল অবশেষে। তারপর একটা তলোয়ার মাছ।
মাছটাকে নিয়ে সমস্যা হল। ওপরের ঠোঁটে লাগানো মারাত্মক তলোয়ারের জন্যেই মাছটার এই নামকরণএই অস্ত্র দিয়ে ইচ্ছে করলে এক খোঁচায় নৌকার তলা এফোঁড় ওফোড় করে দিতে পারে প্রাণীটা।
ধরার পর যথারীতি নিয়ে ট্যাংকে রাখা হল তলোয়ারকে। কিন্তু এক ঘন্টা যেতে না যেতেই জেল থেকে ছাড়া পাবার প্রয়াসে ট্যাংকের দেয়াল ফুটো করে দিল ওটা। সব পানি পড়ে যেতে লাগল। পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর চোখে পড়ল ব্যাপারটা। শুকনো ট্যাংকের তলায় পড়ে খাবি খাচ্ছে তখন বন্দি। তাড়াতাড়ি পাম্প ছেড়ে আবার পানি ভরে বাঁচানো হল তাকে। ফুটোটাও বন্ধ করা হল অনেক। চেষ্টা করে। কিন্তু আবার ঘটতে পারে ওরকম ঘটনা। কি করা যায়?
বুদ্ধিটা বাতলাল রবিন। বক্সিং গ্লাভস পরিয়ে দিলে কেমন হয়?
ইদানীং বক্সিং প্র্যাকটিস করছে মুসা। কয়েক জোড়া গ্লাভস কিনেছে। একজোড়া অন্তত সঙ্গে নিয়ে যায় যেখানেই যায়।
কেবিনে গিয়ে গ্লাভস বের করে আনল মুসা। রবিন আনল একটা থিমবল।
মুচকি হেসে ঠাট্টার সুরে বলল জামবু, এসব দিয়ে ওই তলোয়ার ঠেকাবে নাকি?
জবাব দিল না কেউ।
থিমবলটা বেশ বড়, নাবিকরা ব্যবহার করে এই জিনিস। দরজিরাও আঙুলে পরে, তবে ওগুলো ছোট। তলোয়ার মাছের তলোয়ারটা শক্ত করে চেপে ধরতে বলল রবিন। মুসা ধরলে, থিমবলটা তলোয়ারের মাথায় পরিয়ে দিল সে। গ্লাভস পরাল তার ওপর। তলোয়ারের মাথায় ছুরি দিয়ে ছোট একটা খাজ কেটে গ্লাভসের ফিতে শক্ত করে গিঁট দিয়ে বাঁধল। ব্যস, আর ছুটবে না গ্লাভস।