হঠাৎ বুঝে ফেললো কিশোর, গোলমালটা কোথায়। মিস্ত্রী এসেছে, কিন্তু ভ্যান গাড়ি নেই। কে কবে শুনেছে, ভ্যান ছাড়া টেলিফোন মিস্ত্রী কাজ করতে আসে? ব্যাটা ছদ্মবেশী! তারমানে হলো, হয় তার কাটছে, কিংবা তারের সঙ্গে চোরা লাইন লাগাচ্ছে, যাতে সূব কথাবার্তা চুরি করে শুনতে পারে। এখান থেকে ভালো দেখা যাচ্ছে না। হেঁটে গেলে লোকটার চোখে পড়ে যেতে পারে, তাই হামাগুড়ি দিয়ে। দ্রুত এগোলো কিশোর। কি করছে লোকটা, জানতে হবে।
চলে এলো একেবারে নালার মাথার কাছে। পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে। কয়েক : সেকেণ্ড চুপ করে পড়ে থেকে দম নিয়ে আস্তে মাথা তুললো।
চমকে উঠলো ভীষণ ভাবে! মিস্ত্রীর চোখে চোখ পড়ে গেছে। মাত্র ফুটখানেক তফাতে রয়েছে লোকটার মুখ। বুকের ভেতর কাঁপুনি তুলে দেয়া ভীষণ একজোড়া চোখ। কালো। জন ফেরেনটি!
হাতে মস্ত এক ছুরি!
.
ঝাড়ের ভেতরে ঘাপটি মেরে রয়েছে মুসা। টেরিয়ার কিংবা কিশোর, কারোরই দেখা নেই। রবিনও আসছে না এখনও।
মুসাআ!
সৈকতের দিক থেকে শোনা গেল চিৎকারটা।
মুসাআ! বাঁচাও!
হুড়মুড় করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো মুসা। ঘুরেই দৌড় দিলো শব্দ লক্ষ্য করে। সরু পথ ধরে ছুটে গিয়ে বাড়ির পেছনে মোড় নিতে যাবে, এলো প্রচণ্ড বাধা। খপ করে তার হাত চেপে ধরলো একটা শক্তিশালী থাবা, মুচড়ে নিয়ে গেল। পেছনে পিঠের ওপর, আরেকটা হাত চেপে ধরলো তার মুখ। যাতে চিৎকার করতে না পারে। আটকা পড়লো সে-ও।
.
০৭.
ঝাড়ের কাছে সাইকেল দুটো দেখতে পেলো রবিন। কিন্তু মুসা আর কিশোর কোথায়? মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো, নির্জন পথ। কেউ নেই, কোনো নড়াচড়া। নেই।
হঠাৎ একটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো ডয়েলদের বাড়ির ধারে। দুটো বাড়ির মাঝের সুরু গলি থেকে শাঁ করে বেরিয়ে এলো নীল সেডানটা। তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে রাস্তায় ওঠার সময় কর্কশ আর্তনাদ তুললো টায়ার।
আর্ট ডিলারের গাড়ি! জন ফেরেনটি এখানে কি করছিলো?
বিপ বিপ বিপ বিপ! বেজে উঠলো রবিনের পকেটে রাখা রিসিভার। একটানে বের করে দেখলো কাটাটা পথের দিকে নির্দেশ করছে, ধীরে ধীরে কমে আসছে। জোরালো বিপ বিপ। কি ঘটেছে, বুঝে ফেললো সে।
হোমারটা টেরিয়ারের গাড়িতে লাগাতে পারেনি কিশোর কিংবা মুসা। ধরা। পড়েছে। তাদেরকে বন্দী করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ফেরেনটি।
চোখের আড়ালে চলে গেছে নীল গাড়িটা। বোঝার পর আর বিন্দুমাত্র সময়। নষ্ট করলো না রবিন, সাইকেল নিয়ে ছুটলো ওটার পেছনে। চলতে চলতে উঠে এলো উপকূলের প্রধান সড়কে।
বাঁয়ে মোড় নিলো বিপ বিপ। রকি বীচের উত্তর সীমানার দিকে চলেছে নীল সেডান। ইতিমধ্যে দুই বার সংযোগ হারিয়েছে রবিন, তারপর আবার খুঁজে পেয়েছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও সাইকেল নিয়ে পেরে উঠছে না গাড়িটার সাথে, পারার কথাও নয়। বোধহয় ট্রাফিক পোস্টের লাল আলো জ্বলায় থামতে বাধ্য হয়েছিলো ফেরেনটি, সেই সুযোগেই দুবার কাছে চলে গিয়েছিলো রবিন।
মুহূর্তের জন্যে থামছে না সে, গতি কমাচ্ছে না।
তার পরেও তৃতীয়বার সংযোগ হারালো। নীরব হয়ে গেল রিসিভার।
উত্তেজনা আর পরিশ্রমে দরদর করে ঘামছে রবিন। বুকের খাঁচায় যেন পাগল হয়ে উঠেছে হৃৎপিণ্ডটা। কিন্তু থামলো না সে। দ্রুত প্যাডাল করে এগিয়ে চললো কোস্ট হাইওয়ে ধরে। সামনে পাতলা হয়ে আসছে শহর, খোলা অঞ্চল দেখা যাচ্ছে।
.
টেলিফোনের তার দিয়ে হাত-পা বেঁধে, মুখে রুমাল গুঁজে মুসা আর রবিনকে গাড়ির বুটে ঢুকিয়ে দিয়েছে ফেরেনটি। হাত বেঁধে ফেলার আগেই সেই সুযোগে হোমারের সুইচটা অন করে দিতে পেরেছে কিশোর। মনে মনে এখন লাথি মারতে ইচ্ছে করছে নিজেকে, আগে আরও ভালোমতো খেয়াল করেনি বলে। ট্রেরিয়ারদের বাড়িতে ঢোকার সময়ও খুঁড়িয়ে হাঁটছিলো ফেরেনটি। তবে দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না। ভালো করে লক্ষ্য করলে অবশ্যই বুঝতে পারতো কিশোর। আর তাহলে এখন এই বিপদে পড়তে হতো না।
পথে বার দুই থেমেছে গাড়ি।
তৃতীয়বার থামলো। এঞ্জিন বন্ধ হলো। কিশোর আন্দাজ করলো, মিনিট দশেক পেরিয়েছে।
উঠে গেল বুটের ডালা। টেনে ছেলেদেরকে বুট থেকে বের করলো ফেরেনটি। তারপর একজন একজন করে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ঢোকালো ছোট মোটেলের শেষ মাথার একটা ঘরে। ইতিমধ্যে ছেলেদের সঙ্গে একটা কথাও বলেনি আর্ট ডিলার।
পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসিয়ে ছেলেদের মুখের রুমাল খুলে দিলো। ফেরেনটি। বড় ছুরিটা বের করে হাতে নিয়ে ছেলেদের মুখোমুখি বসলো। চোখের দৃষ্টি ভীষণ। তারপর? পুঁটকি টেরিকে চেনো না, না? ও আসল ছবি আনেনি? মিথ্যুক কোথাকার। তোমরা ওই ছবি চুরি করতে গিয়েছিলে।
চুরি বলছেন কেন? গরম হয়ে বললো মুসা। ওই ছবির আসল মালিক কাউন্টেস। তার জন্যেই কিনে আনতে গিয়েছিলাম।
তাই? কাউন্টেস আর ব্রাউনের হয়ে কাজ করছো তাহলে? কি কি বলেছে ওরা?
বলেছে কাউন্টেসের পারিবারিক জিনসগুলো উদ্ধার করতে চায়, জবাব দিলো কিশোর। সবই পেয়েছি আমরা, ছবিগুলো ছাড়া।
আবার মিথ্যে কথা। আরও কিছু জানো তোমরা। ব্রাউনের প্ল্যান কি? ওরা। আসলে কি খুঁজছে? ওদের কাছে কি মেসেজ পাঠিয়েছিলো রিগ ডেনবার?
আমরা শুধু জানি, মেজাজ দেখিয়ে বললো মুসা। আপনি সারাক্ষণ কাউন্টেসকে ফলো করেছেন। হপ্তাখানেক আগে গিয়েছিলেন প্রফেসর এলউড হোফারের বাড়িতে…।