আনমনে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। বুঝতে পারছি না, কি নিতে এসেছিলো! আমার মনে হয়, ভুল করেছে। আশপাশে বড়লোকের বাড়ি আছে, আমাকেও বড় লোক মনে করেছে আরকি। তাই ঢুকে পড়েছে।…চলুন, মিস্টার পাশা, কাজ শেষ। করি।
কটেজে ফিরে এলো ওরা।
সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন প্রফেসর। বেডরুমের দেয়াল-আলমারি থেকে বের করলেন চামড়ার দুটো পুরনো সুটকেস। একটার ভেতরে শুধু কাপড় চোপড় পুরনো ফ্যাশনের একটা ড্রেস সুট, ধূসর রঙের একটা ফ্লানেল কাপড়ের সুট, কয়েকটা শার্ট, টাই, আর কয়েক জোড়া মোজা। আরেকটা সুটকেসে রয়েছে ছবি আঁকার কিছু রঙ, স্টাফ করা একটা পেঁচা, গ্রীক পুরাণের দেবি ভেনাসের ছোট একটা মূর্তি, বড় একটা বিনকিউলার, আর এক বাক্স রূপার ছুরি, কাঁটাচামচ, চামচ।
সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকতো ডেনবার, বললেন প্রফেসর। পুরনো একটা প্যান্ট আর শার্ট ছাড়া আর কিছুই পরতো না। তবে লোকটা শিক্ষিত ছিলো। আর খাওয়ার সময় এই ছুরি-চামচ ব্যবহার করতো। সাত মাস ছিলো এখানে। লনে একটা ক্যানভাসের চেয়ারে বসে থাকতো, আর ছবি আঁকতে, সর্বক্ষণ। রাতেও। বুঝলেন কিছু?
ঘরের কোণ থেকে ক্যানভাসের আবরণ সরিয়ে বিশটা ছবি বের করে। আনলেন প্রফেসর। এই কটেজ আর তার আশপাশের এলাকার দৃশ্য আঁকা হয়েছে। কোনোটা খুব কাছে থেকে-ক্লোজআপ, আর কোনোটা এতো দূরে, ঘরটা ভালোমতো বোঝাই যায় না।
মন্দ না, একবার দেখেই নজুর ফেরালেন রাশেদ পাশা। সুটকেস দুটো, বিশেষ করে রূপার জিনিসগুলো দেখে চোখ চকচক করছে তাঁর। ঠিকমতো দরদাম করে কিনতে পারলে পুরনো জিনিসে বেশ ভালো লাভ। তবে কাউকে ঠকাতে চান না তিনি, ন্যায্য দাম দেন। এগুলো বিক্রি করবেন?
হ্যাঁ। মৃত্যুর আগে আমাকে একটা ঠিকানা দিয়ে বললো ডেনবার, ওখানে। চিঠি লিখলেই আমার পাওনা টাকা পেয়ে যাবো। লিখেছি, ভাড়া বাকি আছে সে কথাও জানিয়েছি, কোনো জবাব আসেনি। কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি। আর কতো অপেক্ষা করবো? আমার টাকার খুব দরকার?
দাম নিয়ে দর কষাকষি শুরু করলেন রাশেদ পাশা আর প্রফেসর।
রিগ ডেনবারের জিনিসগুলো দেখতে চাইলো কিশোর। একটাও দামী জিনিস নেই, যার জন্যে গাড়িওয়ালা চোর আসতে পারে।
রিকি, জিজ্ঞেস করলো গোয়েন্দাপ্রধান। মিস্টার ডেনবারের কি হয়েছিলো?
অসুখ হয়েছিলো, জানালো রিকি। ভীষণ জ্বর উঠলো। প্রলাপ বকতো, খালি ক্যানভাস আর আঁকাবাঁকা রেখা, না পথ, কি কি সব বলতো। ওর দেখাশোনা তখন আমিই করতাম। শেষে অসুখ এতো বেড়ে গেল, ডাক্তারকে খবর না দিয়ে আর পারলাম না। ডাক্তার আসার আগেই মারা গেল বেচারা। বয়েস, হয়েছিলো, হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বোধহয় বাঁচতো না।
চোরটা ভুলই করেছে, কি বলো, কিশোর? মুসা বললো। দামী কিছুই নেই এখানে।
আস্তে মাথা ঝোঁকালো শুধু কিশোর।
রিগ ডেনবারের জিনিসগুলো কিনে নিয়ে ট্রাকে তোলা হলো। পাহাড়ী পথ ধরে ছুটে চললো গাড়ি। একটা গিরিপথের ভেতর থেকে বেরোতেই বিড়বিড় করলো কিশোর, চোরেরা সাধারণতঃ ভুল করে না, ঘনঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে সে।
কি চুরি করতে এসেছিলো সে, কোনোদিনই জানতে পারবো না আমরা, বললো.মুসা।
তাই তো দেখছি, দীর্ঘশ্বাস ফেললো কিশোর।
.
০৩.
ওই ঘটনার এক হপ্তা পর, এক বিকেলে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে কাজে ব্যস্ত দুই গোয়েন্দা। রবিনই প্রথমে গাড়িটা ঢুকতে দেখলো। হলুদ রঙের একটা মার্সিডিজ গিয়ে থামলো অফিসের সামনে।
চকচকে গাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো মার্জিত পোশাক পরা মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। বিকেলের রোদে তার ধূসর চুল রূপালি দেখাচ্ছে। পরনে শাদা সামার সুট, সিল্কের নীল শার্ট। হাতে সরু কালো একটা বেত, আর একটা কি যেন ঝিক করে উঠলো। এক মুহূর্ত দেখলো ছেলেদের, তারপর ঘুরে রওনা হলো অফিসের দিকে।
চেয়ে রয়েছে ছেলেরা। হঠাৎ বলে উঠলো কিশোর, ওহহহ, ভুলেই গিয়েছিলাম, চাচা-চাচী কেউ নেই অফিসে। চলো, চলো।
গাড়িটার কাছাকাছি এসেছে, এই সময় খুলে গেল পেছনের দরজা। বেরিয়ে এলেন এক লম্বা মহিলা। নীলচে-ধূসর চুল। শাদা সিল্কের পোশাক পরনে। তাতে লাগানো একটা হীরার ব্রোচ। রাজকীয় ভঙ্গিতে তাকালেন ছেলেদের দিকে। মিস্টার রাশেদ পাশা আছেন?
না, ম্যাডাম, জবাব দিলো কিশোর। উনি আমার চাচা। ইয়ার্ডের ভার আমার ওপর দিয়ে গেছেন।
তাই? বয়েস তো বেশি লাগছে না। কাস্টোমার সামলাতে পারো?
পারি।
গুড, হাসলেন মহিলা। কনফিডেন্স থাকা ভালো।
আসলে, হেসে বললো রবিন। পাঁচটার পরে কাস্টোমার বেশি আসেই না।
আবার হাসলেন মহিলা। আমি একজন কাস্টোমার। আর ওই যে অফিসে ঢুকলো, ও আমার এস্টেট ম্যানেজার, ফ্রেড ব্রাউন। চলো ওখানে।
ডেস্কের ওপর ঝুঁকে কি দেখছিলো লোকটা, ছেলেদের ঢুকতে দেখে চট করে সুরে গেল। তবে ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছে কিশোর। ইয়ার্ডের পার্চেজ বুকটা ঘাঁটছিলো ম্যানেজার।
ফ্রেড, মহিলা বললেন। এরাই এখন দায়িত্বে আছে।
ও, ছেলেদের দিকে চেয়ে মাথা সামান্য নোয়ালো ম্যানেজার। ওরা দেখলো, ঝিক করে উঠেছিলো: যে জিনিসটা, ওটা বেতের রূপার হাতল-মুঠো করে ধরার জন্যে। তাহলে তোমাদেরকেই বলি। প্রফেসর হোফারের কাছ থেকে কিছু জিনিস কিনে এনেছো তোমরা, মিস্টার রিগ ডেনবারের জিনিস। ওগুলো ফেরত চাইছেন আমাদের কাউন্টেস, মহিলাকে দেখালো সে। দাম অবশ্যই দেবো। যা দিয়ে কিনেছ, তার ডাবল।