ঘরের ভেতরে ঢুকেছে কিছু একটা! স্কাইলাইট দিয়ে চাঁদের আলো আসছে, সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে বটে ওটাকে, কিন্তু স্পষ্ট নয়।
মাথা ঝাড়া দিলো মুসা। সে-কি জেগে আছে? নাকি এখনও ঘুমিয়ে? আশ্চর্য এক ধরনের অনুভূতি! ঘন তরলের মাঝে সাঁতার কাটছে যেন তার মন। কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না। এই
স্টুডিওর ভেতরে নড়ছে কিছু। চাঁদের আলোয় হালকা একটা কি যেন, ভেসে বেড়াচ্ছে! কাঁপা কাঁপা একটা মূর্তি নিচু হয়ে যেন তুলে নিলো একটা ছবি, ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গেল জানালার কাছে, পলকে বাতাসে মিলিয়ে গেল যেন ছবিটা!
ভূতুড়ে মুর্তিটা দাঁড়িয়েই রয়েছে জানালার কাছে। নড়ে না আর। যুগ যুগ বুঝি পেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু পুরোপুরি সজাগই হতে পারছে না মুসা, ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন।
আবার ছবিগুলোর কাছে ফিরে এলো মূর্তিটা। নিচু হয়ে তুলে নিলো আরেকটা ছবি। আবার গেল জানালার কাছে। গায়ের হয়ে গেল ছবিটা।
দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো মুসা। পা নড়তে চাইছে না।
তার দিকে ভেসে আসছে মূর্তিটা।
গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো মুসা।
.
চাপা চিৎকার শুনতে পেলো কিশোর আর গালিভার। স্টুডিওর ভেতর থেকে এসেছে।
লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড় দিলো দুজনে।
তাড়াতাড়ি তালা খুললেন গালিভার।
বাইরের আলোর তুলনায় ঘরের ভেতরে অন্ধকার। দরজার পাশেই সুইচ, বোর্ড। আলো জ্বেলে দিলো কিশোর।
শুন্য ঘর।
আলমারির কাছে ছুটে গেল দুজনে। মেঝেতে বসে রয়েছে মুসা। মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। সাড়া পেয়ে অনেক কষ্টে সোজা করলো। চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি।
সর্বনাশ! সলভেন্ট আর থিনারের বাম্প! চেঁচিয়ে উঠলেন আর্টিস্ট। ধরো। ধরো, বের করো ওকে।
টেনে আলমারি থেকে বের করা হলো মুসাকে। দাঁড়াতে পারছে না। অসাড় হয়ে গেছে পা।
বগলের নিচে ধরে জোর করে তাকে দাঁড় করালো দুজনে মিলে। হাঁটানোর চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এলো, দাঁড়াতে পারলো মুসা। জোরে নিঃশ্বাস ফেললো।
কি হয়েছিলো? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
ভালোই ছিলাম, ক্লান্ত কণ্ঠে বললো মুসা, কখন জানি ঘুম এসে গেল! চোখ খুলে রাখতে পারলাম না কিছুতেই। তার ঘোরেই দেখলাম ভূতটাকে…
আরি! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। জানালার দিকে চেয়ে আছে।
একদিকের জানালার নিচে পড়ে রয়েছে ডেনবারের একটা ছবি। জানালার পাল্লা খোলা!
বললাম না, ভূত! কেঁপে উঠলো মুসা। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ধপ করে, বসে পড়লো কম্বলে ঢাকা বেঞ্চটার ওপর। ধীরে ধীরে জানালো, কি করে ছবি সরিয়েছে ভূতটা।
নিশ্চয় কেউ ঢুকেছিলো, বললো কিশোর।
আমিও তো তা-ই বলছি ভূত!
আরে দূর! হাত নাড়লো কিশোর। তুমি তো ছিলে আধাবেহুশ হয়ে। মানুষটাকেই ভূত ভেবেছে।
তাহলে মানুষটা কোথায়? দাড়ি নাচালেন গালিভার। ঢুকলো কিভাবে? ওই জানালা দিয়ে কেউ ঢুকতে পারবে না।
অন্য কোনো পথ দিয়ে ঢুকেছে। হঠাৎ চকচক করে উঠলো চোখ। ওই যে, ওই দেখুন!
তাকালো মুসা আর গালিভার। একজস্ট ফ্যানটা যেখানে ছিলো, সেখানেই এখন একটা চৌকোণা ফোকর। ফ্যানটা নেই। টানটান হয়ে রয়েছে তার, প্লগটা : সকেটেই ঢোকানো।
এগিয়ে গিয়ে তার ধরে আস্তে টানলো কিশোর। বাইরের দেয়ালে ঘষা লেগে মৃদু শব্দ হলো। ফ্যানের স্কু ঢিল করে রাখা হয়েছিলো, মিস্টার গালিভার। বাইরে থেকে সহজেই খুলে ফেলেছে ভূতটা। ফোকরের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে কর্ডে।
কিন্তু কিশোর, প্রতিবাদ করলো মুসা, গর্তটা দেখছো না কতো ছোট? বড়; জোর একফুট বাই, একফুট। ওখান দিয়ে মানুষ ঢুকতে পারবে না।
পারবে, যদি তোমার মতো শরীর বড় না হয়। এমন কেউ ঢুকেছে, যার শরীর খুব সরু।
হাঁ করে ফোকরটার দিকে চেয়ে আছেন আর্টিস্ট। মাথা নাড়ছেন আস্তে আস্তে, বিহ্বল হয়ে গেছেন যেন।
এখন আরেকটা কথা, তর্জনী নাড়লো কিশোর। মুসা চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এসে ঢুকেছি। এতো তাড়াতাড়ি পালাতে পারেনি চোর।
ঘরের চারপাশে চোখ বোলালেন গালিভার। তাহলে গেল কোথায়? এখানে, তো নেই।
কই? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
মুসার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিশোর।
কি হলো?
জানি, কোথায় আছে, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর।
কোথায়?
ওর ওপরই বসে আছে।
ছিটকে সরে এলো মুসা, যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে। বড় বড় চোখ করে তাকালো কম্বলে ঢাকা বেঞ্চটার দিকে।
ভারি গলায় ডাকলো কিশোর, এই, বেরিয়ে এসো। আমি জানি, তুমি আছো ওখানে।
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর নড়ে উঠলো কম্বল। উঁকি দিলো একটা মুখ
চোখ মিটমিট করলেন গালিভার।
শুঁটকি! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
.
১৭.
ঘরের কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে টেরিয়ার। চেহারা ফ্যাকাশে। মোটা একটা ডাণ্ডা নিয়ে তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। উঠলেই মারবে বাড়ি।
ওখানে ঢুকেছে, কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করলেন গালিভার।
কম্বলটা সরানো দেখলাম, জবাব দিলো কিশোর। বিকেলে অন্যরকমভাবে রাখা ছিলো।
টেরিয়ারের দিকে ঘুরলেন গালিভার। শেষ পর্যন্ত চুরি করতে ঢুকেছো?
আমাকে বরখাস্ত করলেন কেন? তেজ দেখিয়ে বললো টেরিয়ার।
তাই বলে চুরি করবে? আর বরখাস্ত কি অন্যায়ভাবে করেছি? আমাকে না। জানিয়ে ছবি নিয়ে গেলে…
ফেরত দিয়েছি আবার। মেরে তো দিইনি।