তো, কি বোঝা যাচ্ছে? ভুরু নাচালো মুসা।
আমি কিছু বুঝছি না, রবিন বললো।
ভালো করে দেখো, বললো কিশোর। ধীরে ধীরে ছোট করে ফেলা হয়েছে কটেজটাকে, সঙ্কুচিত। গাছপালা, পাথর, ক্যানভাসের চেয়ার, ডোরাকাটা ছাউনি, সব কিছুর আকার একই রকম রেখেছে, শুধু ছোট করেছে ঘরটাকে। এই যে দেখো না, শেষটায় ছাউনিটা ছাড়া ঘরের আর কিছুই বোঝা যায় না।
বেশ, দেখলাম। কিন্তু তাতে কি? বললো মুসা।
ভূতুড়ে ছবির সঙ্গে যোগ হলো সঙ্কুচিত ছবির রহস্য, হাসলেন আর্টিস্ট। ঠেলা সামলাও এখন।
কিছু থাকলে এই ছবিগুলোতেই আছে, আনমনে বললো কিশোর। রাতের বেলা চোর এসে এজন্যেই এগুলোকে নাড়াচাড়া করে।
এখানে কেউ ঢুকতে পারে না, কিশোর। জোর দিয়ে বললেন গালিভার।
কিন্তু ছবি তো আর আপনাআপনি নড়তে পারে না। ভূত বলেও কিছু নেই। লম্বা একটা বেঞ্চের ওপর বসে পড়লো কিশোর, পুরো বেঞ্চটাই ঢেকে রাখা হয়েছে। বড় একটা কম্বল দিয়ে। স্টুডিওর ভেতরে চোখ বোলালো সে।
গালিভার বসলেন একটা কাউচে। রবিন আর মুসা বসলো দুটো আর্মচেয়ারে।
চোর কে জানতে পারলে হতো, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। তাহলে হয়তো বুঝতাম, ছবিগুলো তার কেন দরকার?
জানার উপায় কি? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
উঠে, স্টুডিওর একমাত্র দেয়াল আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেল গোয়েন্দা প্রধান। পাল্লা খুললো। আলমারির ওপর দিকে দুটো তাক। নিচের অংশটা বড়। ওপরের তাকে আর নিচে সাজানো রয়েছে রঙের কৌটা, ব্রাশ, ছবি আঁকার অন্যান্য সরঞ্জাম। পেছনে নিরেট পাথরের দেয়াল। ফিরে তাকালো সে। জানার একটাই উপায়। আমাদের কাউকে লুকিয়ে থাকতে হবে এখানে।
বেশ, বললেন গালিভার, আমিই থাকবো।
না, আপনি থাকলে হবে না। দরজা-জানালা বন্ধ করে চোরকে দেখিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে আপনাকে। নইলে সে আসবেই না।
তাহলে কে থাকবে?
আমাদের একজন। মুসা, তুমি থাকবে। আপত্তি আছে?
না। তোমরা কি করবে?
আমাদের অন্য কাজ আছে। ভয় পাবে না তো?
ভূত হলে পাবো। আর চোর এলে তো ধরে কিলই শুরু করবো। ভয় কিসের?
হেসে উঠলো কিশোর আর রবিন। এমনকি আর্টিস্টও লাল দাড়ি নাচিয়ে হাহ হাহ করে হাসলেন। ভূত হলেও ভয় নেই। বাইরেই লুকিয়ে থাকবো আমরা। তোমার চিৎকার শুনলেই এসে পড়বো।
কিভাবে পাহারা দেয়া হবে, তার একটা ছক তৈরি করে সবাইকে শোনালো কিশোর। তারপর দুই সহকারীকে নিয়ে বেরিয়ে এলো স্টুডিও থেকে। বাড়ি ফিরে চললো।
তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে আবার গালিভারের বাড়িতে রওনা হলো কিশোর আর মুসা। রবিন আসতে পারলো না, জরুরী কাজে তাকে ডেকে নিয়ে গেছেন মা। ঘন বনের ভেতর দিয়ে নীরবে এগিয়ে চললো দুজনে। থামলো এসে স্টুডিওর সামনে। চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। সন্দেহজনক আঁওয়াজের আশায় কান পেতে রইলো। কিছু শোনা গেল না। মুসার গায়ে কনুই দিয়ে গুঁতো দিলো কিশোর।
ঝোপ থেকে বেরিয়ে এক ছুটে খোলা দরজা দিয়ে স্টুডিওতে ঢুকে পড়লো মুসা। আলমারির ভেতর লুকিয়ে বসলো। পাল্লা ফাঁক করে রাখলো কয়েক ইঞ্চি। যাতে ঘরের ভেতর চোর ঢুকলে দেখতে পায়।
সূর্য ডোবার আগে আগে শব্দ করে জানালা বন্ধ করলেন গালিভার। বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা দিলেন। রোজকার মতোই। তারপর চললেন বাড়ির দিকে।
১৬.
বাইরে রাত নামছে। আলমারির ভেতরে কি আর আরাম করে বসা যায়? বেকায়দা অবস্থায়ই রয়েছে মুসা। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে হাত-পায়ে খিল ধরে যাবে, নিদেনপক্ষে ঝিঁঝি যে ধরবে, তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই।
এক ঘন্টা পেরোলো।
কিছুই ঘটলো না। আলমারিতে বসে থাকতে খুব খারাপ লাগছে মুসার। বদ্ধ ঘর, গরম হয়ে উঠছে। আলমারির ভেতরে গুমোট আরও বেশি। বাইরের খোলা বাতাসে কিশোর আর গালিভার বেশ আরামে রয়েছে ভেবে কষ্ট যেন বেড়ে গেল। তার। অবশ হয়ে আসছে পা।
খিদে পেলো তার। সঙ্গে করে স্যাণ্ডউইচ নিয়ে এসেছে। বের করে খেতে শুরু করলো।
পেরোলো আরও এক ঘন্টা।
.
ঝোপের ভেতর আলোআঁধারি সৃষ্টি করেছে উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। ঘাপটি বসে দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর গালিভার।
দশটা বাজলো। ইতিমধ্যে কাউকে দেখা গেল না। নীরব স্টুডিও।
অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না। খাঁচার ভেতরে চিতাবাঘটার পদচারণা, মাঝে মাঝে চাপা গোঙানি। পোকামাকড়ের ডাক আর নিশাচর ছোট ঘোট জীবের আনাগোনা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
একভাবে বসে থেকে পা ব্যথা হয়ে গেছে। এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভার বদল করলো কিশোর।
কিছুই ঘটছে না।
ঘুম তাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা। এই বেকায়দা অবস্থা আর অসহ্য গরমেও চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে তার। কেমন যেন শূন্য লাগছে মাথার ভেতরটা। এমন তো হয় না। এতে খারাপ লাগছে কেন?
কিছুতেই খুলে রাখতে পারছে না চোখের পাতা। দুবার ঢলে পড়লো তন্দ্রায়। তৃতীয়বার দীর্ঘ তন্দ্রা থেকে চমকে জেগে উঠে মাথা ঝাড়া দিলো। হঠাৎ বুঝতে পারলো, এরকম লাগার কারণটা।
বাম্প!
আলমারি ভরা রঙ, রঙ গোলানোর তেল আর অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য। ভ্যাপসা গরমে ওগুলো থেকে বাষ্প বেরোচ্ছে, বিষাক্ত করে তুলছে আলমারির বাতাস। আর সেই বাতাস ফুসফুঁসে ঢোকাতেই এই অস্বাভাবিক তন্দ্রা।
ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে পড়লো মুসা। কতোক্ষণ পরে জানে না, চোখ মেললো। ঘোলাটে হয়ে আছে মাথার ভেতর, ফলে দৃষ্টি অস্বচ্ছ।