মুচকি হেসে মাথা দোলালেন প্রফেসর। কিন্তু এখানে তদন্ত করার কিছু পাবে না। যা দেখেছো, ওটা ছায়া ছাড়া কিছু না।
ঠিক এই সময় চিৎকার শোনা গেল, চোর! চোর! বাবা, জলদি এসো!
স্থির হয়ে গেল সবাই। কান পেতে শুনলেন প্রফেসর। আরে, রিকি! সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলেন তিনি। পেছনে ছুটলো অন্য তিনজন।
বাবা, তাড়াতাড়ি! আবার শোনা গেল চিৎকার, বাঁয়ে কটেজের দিক থেকে।
.
০২.
লন মাড়িয়ে ছুটলেন প্রফেসর হোফার। ঠিক পেছনেই রাশেদ পাশা আর মুসা। তাদের পেছনে কিশোর।
কটেজের সামনের ছোট ছাউনির নিচে পৌঁছলো ওরা। এক ধাক্কায় দরজা খুলে ছোট একটা লিভিংরুমে ঢুকলেন প্রফেসর। হাঁপাচ্ছেন। চেঁচিয়ে ডাকলেন, রিকবার!…রিকি!
এই যে এখানে, বাবা, জবাব এলো কটেজের খুদে বেডরুম থেকে।
প্রফেসর ঢুকলেন। পেছনে ঢুকলেন রাশেদ পাশা আর মুসা। লিভিংরুমের মতোই এ-ঘরেও আসবাব তেমন নেই। একটা সিঙ্গল খাট, একটা চেয়ার, আর একটা ভারি টেবিল–উল্টে পড়ে আছে। টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ছে একটা ছেলে। রোগী টিনটিনে শরীর।
তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর।
আমি ঠিকই আছি, বাবা, বললো রিকি। নড়াচড়ার শব্দ শুনে ঢুকে দেখি কালো পোশাক আর, কালো মুখোশ পরা একটা লোক। আমি চেঁচিয়ে উঠতেই টেবিলটা উল্টে আমার গায়ের ওপর ফেললো। ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে গেলাম। এই সুযোগে পেছনের দরজা দিয়ে পালালো ব্যাটা।
কিশোরের কথাই ঠিক! বলে উঠলো মুসা। তবে একটা ভুল করেছে। লোকটাকে ঢুকতে নয়, বেরোতে..আরি, কিশোর গেল কই?
ফিরে এসে লিভিংরুমে ঢুকলো মুসা। ওখানেও নেই কিশোর। গেল কোথায়?
কিশোর? চিৎকার করে ডাকলেন রাশেদ পাশা।
আমাদের পেছনেই তো ছিলো, ঢোক গিললো মুসা।
ছেলের দিকে তাকালেন প্রফেসর। লোকটার হাতে কিছু ছিলো? ছুরি, পিস্তল…
দেখিনি।
হঠাৎ আরেকটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল কটেজের পেছন দিক থেকে।
পাক খেয়ে ঘুরলেন প্রফেসর। নালার ওদিক থেকে! হয়তো কেউ পড়ে গেছে!
নালাটা কি খুব গভীর? শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন রাশেদ পাশা।
মোটামুটি। পড়লে হাত-পা ভাঙতে পারে। আসুন আমার সঙ্গে।
ওদেরকে কটেজের পেছনে নিয়ে এলেন প্রফেসর। ছোট ঝোপঝাড়, মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটলো ওরা। নালাটার প্রান্তে এসে থমকে দাঁড়ালো। দশ ফুট মতো গভীর নালাটার দুই মাথা, বাঁক নিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেছে। নিচে আলগা পাথরের ছড়াছড়ি, হালকা গাছপালাও আছে।
কিশোরের চিহ্নও নেই।
দেখুন! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
নিচে, ডানের কয়েকটা পাথরের ওপর কালচেমতো কি যেন লেগে রয়েছে। আলো নেই। ওপর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে নামলো ওরা।
হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো মুসা। ভেজা। রক্ত! আঁতকে উঠলো সে।
.
কালো মূর্তিটা আবার চোখে পড়লো কিশোরের। কটেজের পেছন থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
কিশোর বুঝলো, লোকটাকে সে একাই দেখেছে। অন্যেরা ঢুকে গেছে কটেজে। তাদেরকে ডেকে বের করে আনতে সময় লাগবে, ততোক্ষণে বনে ঢুকে। হারিয়ে যাবে লোকটা। এক মুহূর্ত দ্বিধা করলো গোয়েন্দাপ্রধান, তারপর মোড় নিয়ে ধাওয়া করলো মূর্তিটাকে।
কিন্তু তা-ও দেরি হয়ে গেল। লোকটার চেহারা দেখতে পেলো না সে, তার আগেই ঢুকে গেল জঙ্গলে। ঝোপ মাড়ানোর শব্দ কানে আসছে। কয়েক সেকেণ্ড। পরেই কি যেন গড়িয়ে পড়তে লাগলো, ধ্যাপ করে পাথরের ওপর পড়লো ভারি কিছু। যেন একটা বস্তা পড়েছে। পরক্ষণেই শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার।
এক নালাটার কিনারে এসে দাঁড়ালো কিশোর। নিচে উঁকি দিলো। কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে কালো মূর্তিটা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড় দিলো ডান দিকে, বা পায়ে চোট লেগেছে। হারিয়ে গেল মোড়ের ওপাশে।
বসে পড়লো কিশোর। পার্কের পারে বাচ্চারা যেমন করে স্লীপ করে, তেমনিভাবে পিছলে নামলো নালায়। পাথরে রক্ত দেখতে পেলো। এগিয়ে গেছে রক্তের দাগ। সাবধানে চিহ্ন ধরে ধরে এগোলো সে। বৃষ্টির সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির তীব্র স্রোতের কারণে সৃষ্টি হয়েছে এই নালা। পানি গিয়ে পড়ে ডানের একটা গর্তে, তৈরি করেছে একটা ছোট গিরিখাত, ঘন ঝোপঝাড়ে ভরা। ওটার মধ্যে কেউ লুকিয়ে বসে থাকলে ওপর থেকে দেখা যাবে না।
কিশোর ভাবলো লোকটা ওটার ভেতরেই লুকিয়েছে।
ভুল করেছে। সামনে দড়াম করে বন্ধ হলো একটা গাড়ির দরজা। এঞ্জিন গর্জে উঠলো।
ছুটতে শুরু করলো কিশোর। গিরিখাতের পাশ দিয়ে সরু পথ, সেটা দিয়ে। বেরিয়ে যাওয়া যায় মেইন রোডে।
কিশোর যখন রাস্তার ধারে পৌঁছুলো, গাড়িটা তখন আঁকাবাঁকা পথটার একটা মোড়ের কাছে চলে গেছে। হারিয়ে গেল লাল টেলাইট। শহরের দিকে চলে গেল।
রক্তের দিকে চেয়ে রয়েছে মুসা, চোখে আতঙ্ক। কানে এলো পদশব্দ, কে যেন আসছে।
রাশেদ পাশাও শুনতে পাচ্ছেন। মুসা, শুয়ে পড়ো, জলদি! সবাই…
ছায়ায় লুকিয়ে পড়তে যাবে ওরা, এই সময় দেখতে পেলো, মোড়ের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে কিশোর।
কিশোর? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা, কি হয়েছে?
ব্যাটাকে তাড়া করেছিলাম। ধরতে পারলাম না। পালালো।
কাজটা ভালো করোনি! গম্ভীর হয়ে বললেন রাশেদ পাশা। ছুরিটুরি যদি মেরে বসতো?
ধরতে যাইনি ওকে, চাচা। চেহারা দেখার চেষ্টা করেছি। অন্ধকারে পারলাম। গাড়ি নিয়ে এসেছিলো, পালালো।