বিশাল একটা বাড়িতে থাকেন, বললো রবিন। স্টুডিওটা আলাদা, তবে বাড়ির লাগোয়া। আমরা ছবি খুঁজছি, আর শুঁটকি আর্টিস্টের ওখানে চাকরি করে, কেমন যেন কাকতালীয় ব্যাপার মনে হয় না?
হয়, মাথা ঝোঁকালো কিশোর। খুব বেশি কাকতালীয়ই মনে হয়। জলদি চলো। লাঞ্চ সেরেই মিস্টার গালিভারের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।
.
লোহার উঁচু গেটের বাইরে সাইকেল রাখলো তিন গোয়েন্দা। বিরাট এলাকার ভেতরে দুর্গের মতো মস্ত এক বাড়ির চূড়া চোখে পড়ছে, ঘন গাছপালার জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে। বিকেলের রোদে আসল বনের মতোই লাগছে দেখতে। গেটটা খোলা। কাউকে চোখে পড়লো না।
চলো, ঢুকে পড়ি, বললো মুসা।
ভেতরে ঢুকলো ওরা। আঁকাবাঁকা সরু একটা পথ চলে গেছে বনের ভেতর দিয়ে। সবে পা বাড়িয়েছে এগোনোর জন্যে, ঠিক এই সময় ভেসে এলো তীক্ষ্ণ এক চিৎকার। যেন তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছে কোনো মেয়েলোক কিংবা বাচ্চা ছেলে!
কী? ফিসফিস করে বললো রবিন।
ভূত না তো! ভয় পেয়ে গেছে মুসা। চলো, ভাগি!
আবার শোনা গেল চিৎকারটা। বাঁয়ে।
কেউ বিপদে পড়েছে!!
চলো তো, দেখি, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললো কিশোর। খবরদার শব্দ করবে না!
পথ থেকে সরে গাছের আড়ালে এগোলো ওরা।
শোনা গেল আবার রক্ত-পানি-করা চিৎকার। ঠিক সামনে। দুহাতে ঠেলে : কয়েকটা পাতা সরালো কিশোর। একটুখানি ভোলা জায়গা! ওখানে বসে রয়েছে। একটা ভয়ানক জানোয়ার। চোখ এদিকেই।
স্তব্ধ হয়ে সবুজ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেরা।
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলো জীবটা। দেখালো মারাত্মক শ্বদন্ত।
চিতাবাঘ! গলা কাঁপছে কিশোরের। দৌড় দাও! কুইক!
না! মানা করলো মুসা। বাঘটার চোখে চোখে তাকিয়ে রয়েছে। যেখানে রয়েছে দাঁড়িয়ে থাকে। দৌড় দিলেই এসে ধরবে।
হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে থাকো। একেবারে চুপ, পেছন থেকে বলে উঠলো আরেকটা কণ্ঠ। দৌড় দিলেই মরবে।
ঝট করে ফিরে তাকালো তিনজনে।
বিশালদেহী এক লোক, যেন একটা গ্রিজলি ভালুক। লাল দাড়ি, লাল ঘন চুল। চোখে আগুন। হাতে একটা বল্লম, ঝকঝকে ফলাটা তিন ফুটের কম হবে না।
পাথর হয়ে গেল যেন তিন গোয়েন্দা। পালানোর পথ নেই। সামনে চিতাবাঘ, পেছনে বল্লম-হাতে এক ভালুক!
বিকট গর্জন করে ওদের দিকে লাফ দিলো চিতাটা।
.
১৪.
মাঝপথে অদৃশ্য কোননা দেয়ালে বাড়ি খেয়ে যেন থেমে গেল চিতাবাঘ, ধুপ করে পড়লো মাটিতে। নাকে মুখে ব্যথা পেয়েছে। আহত কুকুরের মতো একবার কুঁইকুই করে আবার ফিরে গিয়ে বসলো আগের জায়গায়। সবুজ চোখ জ্বলছে। ছেলেদের ধরতে না পেরে রেগে গেছে।
কি-ক্কিভাবে, গলা এতো কাঁপছে, কথাই বলতে পারছে না রবিন।
হাত বাড়ালো মুসা। পাতার ওপাশে, মাত্র ফুটখানেক দূরে ঠেকে গেল হাত। কাঁচ! কাঁচের খাঁচায় ভরে রাখা হয়েছে। এতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, দেখিইনি। পুরো খোলা জায়গাটাই একটা বিশাল কাঁচের খাঁচা!
বুঝেছো তাহলে, বললেন লাল-দাড়িওয়ালা লোকটা। তোমাদের কি ধারণা, চিতাবাঘ ছেড়ে রাখবো মানুষের ঘাড় মটকানোর জন্যে?
না,না, মিনমিন করে বললো কিশোর, তা কেন…
রবিন জিজ্ঞেস করলো, ওটাকে কাঁচের খাঁচায় ভরেছেন কেন, স্যার?
নাহলে স্টাডি করবো কিভাবে? কি করে হাঁটে ওটা, পেশী নাড়ায়, হাঁ। করে…না দেখলে আঁকবো কিভাবে? জ্যান্ত হবে ছবি?
আপনিই আর্টিস্ট! এতোক্ষণে বুঝলো কিশোর। মিস্টার নরম্যান গালিভার, বিখ্যাত…
চিতাবাঘের ছবি আঁকবেন, বললো রবিন।
হ্যাঁ, আঁকবো। আফ্রিকান অনেক কিছুর ছবিই আমি এঁকেছি। ওসব কথা থাক। বল্লমটা নাড়লেন গালিভার। এটা দেখো। আফ্রিকান মাসাই উপজাতির লোকেরা এ-জিনিস দিয়ে সিংহ মারে। ছেলেদের সই করে তুললেন অস্ত্রটা। আরও অনেক কিছু মারা যায়। এই যেমন ধরো, মানুষ। বলো এখন, আমার স্টুডিওতে ঢুকেছো কেন? চুরি করার জন্যে?
আমরা চোর নই, মেজাজ দেখিয়ে বললো মুসা। কেউ তাকে চোর বললে সাংঘাতিক রেগে যায়।
বাহ, রাগও আছে। তাহলে চুপি চুপি আমার বাড়িতে ঢোকার কারণ?
আমরা, স্যার, ডিটেকটিভ, জবাব দিলো কিশোর। কথা বলতে এসেছি। আপনার অ্যাসিসটেন্ট টেরিয়ার ডয়েল…
টেরিয়ার? ওই শয়তানটার সঙ্গে সম্পর্ক? হুঁ তোমরাও বাজে ছেলে। যাও, আগে বাড়ো। পুলিশে দেবো তোমাদের, হাতের বল্লম নাচালেন আর্টিস্ট।
দুর্গের ভেতরে বড় একটা ঘরে ছেলেদের নিয়ে এলেন। শেলফ ভরতি বই। কেমন বিষণ্ণ পরিবেশ।
পুলিশকে ফোন করবেন তো, স্যার? কিশোর বললো। চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে চান।
কেন?
আমাদের নাম বললেই উনি চিনতে পারবেন। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড, সেই সঙ্গে পুলিশ চীফের সার্টিফিকেটটা বের করে বাড়িয়ে দিলো কিশোর।
সইটা তো আসলই লাগছে। চীফেরই সই কি করে জানবো?
করুন না, তাঁকে ফোন করুন। নইলে আরেক কাজ করতে পারেন। আর্টিস্ট যখন, নিশ্চয় মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের সঙ্গে পরিচয় আছে…
ফিল্ম প্রডিউসার? ডিরেক্টর?
হ্যাঁ।
সে-ও তোমাদের চেনে নাকি? এইবার সত্যি সত্যি বিপদে পড়লে, ইয়াং ম্যান। মিছে কথা এবার ফাঁস হবে, বলতে বলতে রিসিভারের দিকে হাত বাড়ালেন গালিভার। কানে ঠেকিয়ে ডায়াল করলেন। কে? ডেভিস? আমি নরম্যান। তিনটে ছেলে চুরি করে ঢুকেছে আমার বাড়িতে, বলছে তিন গোয়েন্দা…কি বললে?…হা হা, ওরকমই চেহারা..তাই নাকি?…ভেরি গুড। আচ্ছা, রাখি। গুড বাই। রিসিভার নামিয়ে রেখে ফিরে চেয়ে হাসলেন আর্টিস্ট। নাহ, ফাসাতে পারলাম না তোমাদের। বল্লমটা নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন ঘরের কোণে। তা এখানে কি রহস্যের খোঁজে এসেছো?