ভয়ঙ্কর লাগছে কালো গহ্বরটা, যেন কোনো দানবের হাঁ করা মুখ।
বেশ, আমিই যাচ্ছি, অসাধারণ দুঃসাহস দেখিয়ে বসলো রবিন। কেউ বাধা দেয়ার আগেই গুড বাই বলে পা নামিয়ে দিলো ফোকরের ভেতরে। দুই হাতে কিনার ধরে রেখে ঝুলে রইলো এক মুহূর্ত। তারপর ঢিল করে দিলো আঙুলগুলো।
পড়তে লাগলো নিচে। কালো অন্ধকার গ্রাস করলো যেন তাকে।
.
১০.
কালো মুখটা দিয়ে নিচে উঁকি দিলো অন্য তিনজন।
রবিন? ডাকলো মুসা।
ভালোই আছি আমি, জবাব এলো নিচে থেকে। সুড়ঙ্গই। বালি আর ইটের ঔড়োয় ভরা। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হাত বাড়ালে দেয়াল হাতে লাগছে। এক মিনিট দাঁড়াও, আরও ভালোমতো দেখে নিই।
নিচে নড়াচড়া শোনা গেল। ছেলেদের মনে হলো কয়েক ঘন্টা পেরিয়েছে, আসলে পেরোলো মাত্র কয়েকটা মিনিট। আবার শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ, একদিকে ছয় ফুট গেছে, বোধহয় লিভিংরুমের তলায়। ওখানে আরেকটা ট্র্যাপডোর আছে। অনেক টেনেটুনে দেখলাম, খুলতে পারলাম না। ওটা খোলা গেলে হয়তো বেরোনো যাবে।
কিশোর, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। সুড়ঙ্গটা কোথায় গেছে কি করে জানবো?
হারিয়ে যেতে পারি, বললো রিকি।
ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। ডেকে জিজ্ঞেস করলো, রবিন? বাতাস কেমন ওখানে?
ভালোই। শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে না। তবে স্থির হয়ে আছে।
কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দ্বিধা করছে গোয়েন্দাপ্রাধান! কোথায় গেছে সুড়ঙ্গটা? বলা যায় না, কি হবে! সাংঘাতিক বিপদে পড়তে পারি, বললো সে। মারাও যেতে পারি। কিন্তু এখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। চেষ্টা করে দেখা দরকার। যে আটকে রেখে গেছে আমাদের, তার উদ্দেশ্যও জানি না। হয়তো ফিরে আসবে ছুরি নিয়ে…
আমি নামছি, কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো মুসা। রবিনের মতো একই কায়দায় নেমে গেল।
তার পরে গেল রিকি। সব শেষে কিশোর।
একে অন্যের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো ওরা। এভোই অন্ধকার, কিছু দেখতে পেলো না। ঠাণ্ডাও বেশ। বেশিক্ষণ এখানে থাকতে হলে শীতেই কাবু হয়ে যাবে।
চলো, এতোক্ষণ ভয় পাচ্ছিলো বটে, কিন্তু সময়মতো ভয়ডর, সব চলে গেল মুসার, নেতা হয়ে গেল। আমি আগে যাচ্ছি। কিশোর, তুমি আমার পেছনে থাকো। রবিন, রিকি, তোমরা কিছুটা দূরে থাকো। যদি খাদেটাদে পড়েই যাই, তোমরা অন্তত… কথা শেষ করলো না সে।
ট্রাপডোরটা খোলা গেল না। উল্টোদিকে আরেকটা সুড়ঙ্গ আছে। সেটা ধরেই এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলো মুসা। গাঢ় অন্ধকারে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে আগে বাড়লো। ধীরে ধীরে নিচু হয়ে আসছে ছাত। ঝুঁকতে ঝুঁকতে শেষে বাঁকা হয়ে গেল, কুঁজো মানুষের মতো।
মনে তো হয় সোজাই গেছে, বললো, মুসা। ঠিক বুঝতে পারছি না।
এগিয়ে চলেছে ওরা।
প্রতিটি পা মেপে মেপে ফেলছে মুসা। ফেলার আগে দেখে নিচ্ছে সামনে মাটি আছে, নাকি শূন্য। কথা বলছে না কেউ। গভীর অন্ধকার আর ভীষণ নীরবতা– চেপে ধরছে যেন ওদেরকে।
মুসা, এক সময় বললো কিশোর। কি যেন নড়ছে।
জমে গেল চারজনেই।
বাতাস! বলে উঠলো রবিন। বাতাস নড়ছে।
আবার এগোলো মুসা। গতি সামান্য বাড়ালো। সামনে একটা মোড়।
মোড় ঘুরতেই মনে হলো, সামনে অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে আছে।
সুড়ঙ্গমুখ! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
আর বিশ কদম এগিয়েই খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে এলো ওরা। হাসলো একে অন্যের দিকে চেয়ে। এখন নিরাপদ। বন্ধ কারাগার, ভয়াবহ অন্ধকার থেকে যুক্তি মিলেছে শেষ অবধি। ওই অন্ধকারের পর জ্যোৎস্নাকে মনে হলো উজ্জ্বল সূর্যের আলো।
নালাটায় বেরিয়েছি, চারপাশে দেখে বললো রিকি।
নালার ভাটিতে রয়েছে ওরা। উজানের দিকটা উঠে গেছে অনেক ওপরে। যেখান দিয়ে বেরিয়েছে ওরা, সেটাকে দেখে মনে হয় কালো একটা সাধারণ গর্ত, ঝোপঝাড়ে ছাওয়া। সুড়ঙ্গমুখ যে, বোঝার উপায় নেই।
চলো, বলে পা বাড়াতে গিয়েই থেমে গেল কিশোর।
মাত্র দশ গজ দূরে ধুপ করে নালায় পড়লো কে যেন! অসাবধানে পা বাড়াতে গিয়েই বোধহয় পড়েছি। বাবারে! বলে চেঁচিয়ে উঠলো।
কে? বলে এগিয়ে গেল মুসা।
হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো লোকটা। চাঁদের আলোয় তার চেহারা দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো মুসা। ঘুরেই দিলো দৌড়। চেঁচিয়ে বললো, পালাও, পালাও! জন ফেরেনটি…
অন্যেরাও দৌড়াতে শুরু করলো মুসার পেছনে।
এই শোনো, থামো থামো।
কিন্তু কে শোনে ডাক? ছুটছে তো ছুটছেই ওরা। পেছনে আসছে ফেরেনটি। পাথরে লেগে তার জুতোর শব্দ হচ্ছে। থামলো তো না-ই, গতি আরও বাড়িয়ে দিলো ছেলেরা।
জলদি করো! বললো মুসা। সাইকেলের কাছে।
মোড় ঘুরতেই হঠাৎ সামনে পড়লো আরেকজন। মুসার হাত চেপে ধরলো। ঝাড়া দিয়ে চুটিয়ে নিয়ে চিৎকার করে বললো সে, খবরদার, কেউ থেমো না! ধরতে যেন না পারে! উত্তেজনায় মানুষটার মুখের দিকেও তাকালো না, হাত। ছাড়িয়ে নিয়েই আবার দৌড়।
এই রিকি! আমি!
আরি, বাবা!
থেমে গেল ছেলেরা।
হাঁপাতে হাঁপাতে মুসা বললো, ফেরেনটি তাড়া করেছে আমাদের।
অ্যাডোবে আটকে রেখেছিলো, জানালো রিকি।
ভাগ্যিস গোপন সুড়ঙ্গটা পেয়ে গেলাম, যোগ করলো রবিন। নইলে এখনও ওখানেই আটকে থাকতাম।
নালার ভাটির দিকে তাকালেন প্রফেসর। কই, কাউকে তো দেখছি না।
ছেলেরাও ফিরে তাকালো। সত্যি, কেউ নেই। শুধু নীরব চাঁদের আলো।