কি ওগুলো? রিকির কণ্ঠে বিস্ময়।
কোনো মেঠো ইঁদুর কিংবা কাঠবেড়ালির রত্ন, নিরাশ হয়ে বললো কিশোর।
মানে?
দেখছো না? একর আর পাইন নাট।
ওক আর পাইনের ফলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। প্রথম হাসলো। মুসা। হ্ হুঁহ হাসি থেকে বাড়তে বাড়তে একেবারে অট্টহাসি। সংক্রামিত হলো অন্যদের মাঝেও। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেল ওদের। একজন কোনোমতে থামলে অন্যদের হাসি দেখে আবার হেসে উঠছে।
এই হাসির জন্যেই টের পেলো না, বসার ঘরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যখন পেলো, দেরি হয়ে গেছে।
হাসি থামিয়ে দরজার দিকে চেয়ে বললো মুসা, আরে…?
কথা শেষ হলো না। দরজার ওপাশে খসখস শব্দ। খিল লাগানোর আওয়াজও শোনা গেল।
এই, কে? চেঁচিয়ে উঠলো রিকি। কে তুমি? কে?
খোলো খোলো, দরজা খোলো! রবিন বললো।
পাল্লার ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মুসা। জোরে ঠেলা দিয়ে বললো, এই, বন্ধ করছো কেন?
থামো তোমরা, বললো কিশোর।
চুপ করলে অন্যেরা। বসার ঘরে নড়াচড়া করছে কেউ। জিনিসপত্র নাড়ছে। দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ। আছড়ে ভাঙছে ছবি আঁকার ফ্রেম, ছুঁড়ে ফেলছে তেল আর রঙের কৌটা, টিন।
খুঁজছে ব্যাটা, ফিসফিস করে বললো কিশোর।
আরও কয়েক মিনিট ধরে চললো বিচিত্র শব্দ। ক্ষণিকের জন্যে নীরবতা। বাইরের দরজা বন্ধ হলো, তালা লাগানোর আওয়াজও বোঝা গেল।
সর্বনাশ হয়েছে! গুঙিয়ে উঠলো রিকি। তালায় চাবি লাগিয়ে রেখে এসেছিলাম!
.
শোবার ঘরে একটা মাত্র জানালা। পুরু কাঠের শক্ত পাল্লা। খুলে যাতে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে সেজন্যে মোটা তক্তা আর পেরেক দিয়ে বাইরে থেকে শক্ত করে বন্ধ করে দিয়েছেন রিকির বাবা। খুলতে হলে ছেনি-হাতুড়ি লাগবে।
বাইরে রাত নেমেছে। পাল্লার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো আসছে ঘরে।
কয়েক ঘন্টা হলো আটকে রয়েছে ছেলেরা। চেঁচিয়ে গলা ব্যথা করে ফেলেছে। কিন্তু কে শুনবে? হোফার হাউস থেকে অনেক দূরে এই অ্যাডোব। চেঁচামেচি করে লাভ হবে না বুঝে বেরোনোর অনেক চেষ্টা করেছে, ছেলেরা। সুবিধে করতে পারেনি। ভীষণ পুরু দেয়াল। মুসার পকেট নাইফ কিংবা কিশোরের আটলার সুইস নাইফ দিয়ে খুঁচিয়ে দেখেছে, প্রায় দাগই ফেলতে পারেনি। দেয়ালে। বুঝেছে, বেশি চাপাচাপি করতে গেলে অযথা ছুরির ফলাই ভাঙবে, দেয়ালে গর্ত হবে না। দরজা খুলতে পারেনি, জানালা তো নয়ই। ঘরের মেঝেতে লাথি মেরে বুঝেছে, নিচে ফাঁপা, বোধহয় বেসমেন্ট আছে। কিন্তু ওখানে নামার পথ খুঁজে পায়নি।
হতাশ হয়ে এখন বসে রয়েছে পুরনো গদিটার ওপর। ডিনারের সময় হয়ে গেছে, আফসোস করে বললো মুসা।
আর ডিনার! জোরে নিঃশ্বাস ফেললো রবিন। কাল সকালের নাস্তা করতে পারবো কিনা সন্দেহ। আটকা পড়লাম ভালোমতোই।
রিকি বললো, বাবা আমাকে না দেখলে খুঁজবে। খুঁজে বের করবে।
কি করে জানবে, এখানে এসেছো? প্রায়ই আলো নাকি? জানেন তোমার বাবা?
না।
তাহলে কেন এখানে খুঁজতে আসবেন?
আবার নীরবতা।
কিছুক্ষণ পর কি মনে হতে উঠলো মুসা। একদিকে দেয়ালের কোণ ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে একটা দেয়াল আলমারি। সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েকবার পা ঠুকলো মেঝেতে। বেসমেন্টে নামতে পারলে হতো। হয়তো বেরোনোর পথ পাওয়া যাবে। কিন্তু নামি কিভাবে?
রিকিও গিয়ে মুসার পাশে দাঁড়ালো। অ্যাডোবের নিচে যে ভাড়ার ঘর আছে, জানতামই না। কেন বানালো বুঝতে পারছি না! বিড়বিড় করলো আপনমনে, ক্যালিফোর্নিয়ায় এসব বানায় না লোকে!
না, তা বানায় না, বললো কিশোর। আর এরকম পুরনো অ্যাডোবের নিচে তো নয়ই। এক মুহূর্ত ভাবলো। তারপর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো, উত্তেজিত। এখন অ্যাডোবের নিচে ভাড়ার বানায় না। কিন্তু যখন আমেরিকান আর স্প্যানিশরা শত্রু ছিলো? পালানোর জন্যে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রাখতো। নিশ্চয় এটার তলায়ও ওরকম কিছু আছে। আবছা আলোয় পুরো ঘরে আরেকবার চোখ বোলালো সে। বিড়বিড় করলো, নামার পট। কোথায়?… আলমারিটার দিকে তাকিয়ে রইলো এক মুহূর্ত। ওটার নিচে…
কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই হুমড়ি খেয়ে বসে পড়লো রবিন আর মুসা। হাত দিয়ে মুছে ফেললো পুরু ধুলো আর ইট-মাটির গুঁড়ো। একটা চিড়মতো দেখা গেল। ওটার মধ্যে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে নেড়েচেড়ে, চাপ দিয়ে দেখলো মুসা। এই, নড়ছে! চেঁচিয়ে উঠলো সে।
রবিন আর সে মিলে টেনে তুললো একটা তক্তা। নিচেও ধুলো আর মাটির পুরু আস্তরণ। ওগুলো সরাতে বেরিয়ে পড়লো একটা ট্র্যাপড়োর, লোহার মরচে ধরা বড় আঙটা লাগানো। আঙটাটা চেপে ধরে টান দিতেই উঠে এলো। ট্র্যাপোডোর। ফোকরের তলায় ঘন অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না।
দেখা যায় না, অস্বস্তিতে ভরা রবিনের কণ্ঠ।
নাহ, বললো রিকি। খালি অন্ধকার।
সুড়ঙ্গ থাক আর যা-ই থাক, আমি নামছি না ওখানে, সাফ বলে দিলো মুসা।
বেশ, থাকো, বললো কিশোর। ফেরেনটির হাতের ছুরির কথা মনে আছে? রাতের বেলা খুন করতে আসতে পারে।
ভয় দেখাচ্ছো? আসুক ছুরি নিয়ে। দরকার হয় লড়াই করবো। কিন্তু আমি ওই অন্ধকারে নামছি না। শুনেছি স্প্যানিশ ভূতগুলো সবচেয়ে পাজি।
অন্য সময় হলে হেসে ফেলতো সবাই, এখন হাসলো না।
ইস, একটা টর্চও যদি থাকতো! জিভ দিয়ে চুক চুক করলো কিশোর। কিন্তু কেউ একজনকে তো নামতেই হবে।