বেডরুম থেকে দেখলো ওরা, কটেজে ঢুকেছে রিকি। কোনোদিকে খেয়াল, নেই, সোজা এগিয়ে গেল লিভিংরুমের এক কোণে। আঁলগা একটা বোর্ড সরিয়ে, আরও ঝুঁকে হাত ঢুকিয়ে দিলো মেঝের নিচে।
নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা।
তাহলে তুমি জানো, কি লুকিয়েছিলো ডেনবার? শান্ত কণ্ঠে বললো কিশোর।
.
০৯.
হুফ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রিকি। তোমরা। বুকে কাঁপুনি তুলে দিয়েছে।
তোমার হাতে কি? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
দেখালো রিকি। পুরনো আমলের বড় একটা চাবি। প্রশ্ন করলো, তোমরা এখানে কি করছো? ভাবছো, এই কটেজেই কিছু লুকিয়েছে ডেনবার?
তোমার কি মনে হয়? পাল্টা প্রশ্ন করলো কিশোর।
আমারও তা-ই মনে হয়। তোমরা চলে যাওয়ার পর হঠাৎ মনে পড়লো কথাটা, ছুটে চলে এলাম। বাবা এখনও ওই দুজনের সঙ্গে কথা বলছে।
কি মনে পড়লো? জানতে চাইলো রবিন।
মাঝে মাঝে অ্যাডোবে যেতে ডেনবার। ক্যানিয়নের ওধারে। ছবিগুলো, ওখানেই রাখতো। ঘরটা খালি থাকে, তালা দিয়ে রাখে বাবা, যাতে কেউ ঢুকে নষ্ট করতে না পারে। ঐতিহাসিক মূল্য আছে ওটার। তবে, বুড়ো ডেনবার ঢুকতো,
আমিই তাকে চাবি এনে দিয়েছিলাম।
এটাই কি সেই চাবি? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
হ্যাঁ। বাবা মেহমানদের সঙ্গে কথা বলছে। তোমরাও, চলে গেলে। ভাবলাম, এইই সুযোগ। অ্যাডোবে গিয়ে খুঁজে দেখি।
ভালোই হলো। চলো, আমরাও যাই।
বাইরে বিকেলের রোদ। তিন গোয়েন্দাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো রিকি। পথ থেকে দূরে নালার ধার দিয়ে হাঁটছে ওরা। হোফার হাউসকে দূর দিয়ে ঘিরে এগিয়ে গেছে নালাটা, তারপর হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে ঢুকে পড়েছে একটা গিরিসঙ্কটে।
কিছুক্ষণ পর বাঁয়ে ঘুরলো রিকি। ঘন ঝোপের ধার দিয়ে চললো। পেছনে তিন গোয়েন্দা।
আরও সামনে ঘন ঝোপঝাড়, মোটা মোটা লতা। ওগুলোর ভেতর দিয়ে পথ করে হাঁটাই মুশকিল। তবে পথ একটা করাই আছে, রিকি সঙ্গে না এলে খুঁজে পেতো না তিন গোয়েন্দা। ঝোপের ভেতর থেকে বেরোতেই দেখা গেল বনের মাঝে একটা খোলা জায়গা। একধারে শক্ত হয়ে আছে কাদার স্তূপ। আরেকধারে। একটা ছোট কুঁড়ে। কাঠের নিচু ছাত, খড়খড়ি লাগানো জানালা। রোদে শুকানো ইঁট দিয়ে তৈরি। নীরব, নিঃসঙ্গ। এটাই অ্যাডোব।
এই ক্যানিয়নের প্রথম মালিক এক স্প্যানিশ। সে-ই বানিয়েছিলো ওই কুঁড়েটা, জানালো রিকি। দেড়শো বছরেরও বেশি আগে। ভেতরে শুধু একটা ফায়ারপ্লেস আছে। বাথরুমও নেই।
এই চাবি দিয়ে তালা খুললো রিকি। মোটা তক্তার পাল্লা, তাতে লোহার পাত লাগানো। পাতের এক মাথা গোল করে চৌকাঠে লাগানো মোটা লোহার বাকা শলায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে, এই প্রাচীন কজার ওপরই খেলে পাল্লাদুটো।
ঠিকই বলেছে রিকি। তিন গোয়েন্দা ঢুকে দেখলো, ভেতরে প্রায় কিছুই নেই। কাঠের মেঝেতে পুরু হয়ে জমেছে ধুলো আর কাঁচা ইটের গুঁড়ো। দুটো ঘর। দুটোই ছোট। একটাকে বোধহয় বসার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো, আরেকটা শোবার ঘর–ওটার সংলগ্ন রান্নাঘর। জানালার পাল্লাগুলো বাইরের দিকে খোলে। ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে ম্লান আলো। ঘরের ভেতর বেশ ঠাণ্ডা।
খাইছে! বলে উঠলো মুসা। দেয়াল কি পুরুরে বাবা। তিন ফুটের কম হবে না।
অ্যাডোব এভাবেই তৈরি হতো, রবিন বললো আগুনে-পোড়া ইটের মতো শক্ত হয় না রোদে পোড়া ইট। ফলে বড় আর পুরু করে বানাতে হতো, যাতে দেয়াল তৈরি করলে ভার রাখতে পারে।
মুসা, রবিনের কথা শেষ হলে কিশোর বললো, রান্নাঘরটায় খোজো। রবিন, তুমি খোজো শোবার ঘরে। আমি আর রিকি খুঁজছি বসার ঘরটায়।
অব্যবহৃত অনেক ক্যানভাস দেখতে পেলো কিশোর। রঙ পাতলা করার তেলের টিনও আছে। কিন্তু কোনো ছবি নেই। অলংকরণ করা একটা সোনালি ফ্রেম রয়েছে। সেটার দিকে চেয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো সে। আনমনে বললো, এটাকে খালি রেখেছিলো কেন ডেনবার?
এটাতে আরেকজনের আঁকা একটা ছবি ছিলো, বললো রিকি। নকল ছবি। ডেনবার বলতো, প্রিন্ট। বলতো, প্রিন্ট মোটেই পছন্দ করে না সে, তাই খুলে ফেলে দিয়েছিলো।
কিন্তু ফ্রেমটা ফেলেনি। ডিজাইনগুলো দেখেছো?
আঁকাবাকা! কিশোর, এটার কথা বলেনি তো?
রিকির কথা যেন শুনতেই পেলো না গোয়েন্দাপ্রধান। বেশ পুরু। ভেতরে অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখা সম্ভব।
ফ্রেমটা ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখলো দুজনে। জোড়াগুলো দেখলো। আঁকাবাঁকা অলংকরণগুলোতে আঙুল চালিয়ে, টিপেটুপে দেখলো। অবশেষে মাথা নাড়লো কিশোর, না, নেই কিছু। তাহলে কোথায় কি আছে?
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো মুসা। পেলাম না। কিছু থেকে থাকলে, দেয়ালের মধ্যে লুকানো রয়েছে।
আমরাও কিছু পাইনি, জানালো রিকি।
এই, দেখে যাও! শোবার ঘর থেকে রবিনের ডাক শোনা গেল। এইযে, এখানে।
এক কোণে ফেলে রাখা জীর্ণ মলিন একটা বিছানার গদির কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। খোলের কাপড়ে তির্যক রেখা আঁকা ডিজাইন। আমার বিশ্বাস, এটার ভেতরে কিছু আছে। ফুলে থাকা একটা জায়গা দেখালো।
টিপে দেখলো মুসা। খাইছে! নিশ্চয় পাথর। রত্ন! অনেকগুলো।
কাটো কাটো, জলদি কাটো, বললো কিশোর।
পকেট থেকে পেন্সিল কাটার ছোট ছুরি বের করে গদির ওই জায়গাটা কাটলো মুসা। চারপাশ থেকে বুকে এসেছে অন্যরা। মাথা ঠুকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে। গোল গোল পাথরের মতোই কতগুলো জিনিস বেরোলো।