একটা মানিব্যাগ পড়ে আছে দেখে তুলে নিয়ে খুলল কিশোর। খালি। একটা চেয়ার উল্টে পড়ে আছে, পায়ায় রক্ত। মারামারিও হয়েছিল মনে হচ্ছে?
মাথা নোয়াল লোকটা। হ্যাঁ, গলায় জোর নেই।
একাই থাকেন?
আবার মাথা নোয়াল।
খুব বিপজ্জনক জায়গা। ইনডিয়ানদের এলাকা, না?
ডাকাতরা ইনডিয়ান নয়।
ইনডিয়ান নয়? তাহলে… থেমে গেল কিশোর। ভ্যাম্প না-তো? কি ভাষায় কথা বলেছে?
ইংরেজি, অশুদ্ধ। আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল, দুটো বড় নৌকা দেখেছি কিনা, জানোয়ার বোঝাই। বললাম, না। খাবার চাইল। আট-দশজন লোকের কম লাগে? তা-ও যা পারলাম, দিলাম। আরও চাইল। শেষে আমার সমস্ত সাপ্লাই কেড়ে নিল। বাধা দেয়ায় আমাকে ঘুসি মেরে ফেলে দিল দৈত্যটা।
ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের মত চেহারা?
তুমি জানলে কিভাবে?
আমাদের পিছু নিয়েছে ওরা। মেঝের রক্ত দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ভ্যাম্পের?
না, আরেকটার। আমার বন্দুক-টন্দুক আগেই কেড়ে নিয়েছে। দৈত্যটাকে ছুরি মারতে গেলাম। সরে গেল সে, ছুরি গাধল তার পেছনের লোকের গায়ে। রাগে। ওই ব্যাটাই আগুন লাগিয়েছে ঘরে। আমার সবকিছু নিয়ে চলে গেছে। আমাকে ফেলে গেছে কষ্ট পেয়ে মরার জন্যে।
দেখে তো ইংরেজ মনে হয় না আপনাকে। কিন্তু ইংরেজি তো ভালই বলছেন?
আমি ব্রাজিলিয়ান। নাম বুয়েনো ল্যানসো। রিওতে স্কুলে ইংরেজি শিখেছি।
বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, শুয়ে পড়ল আবার লোকটা। কয়েক সেকেণ্ড জিরিয়ে নিয়ে বলল, রিওতে এখন স্লোগান, দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ও গো ওয়েস্ট, ইয়াং ম্যান। আমাদের সরকার চায়, এই পতিত অঞ্চলটাও আবাদ হোক। তাই আমি চলে এসেছি এখানে। হয়তো বোকামিই করেছি, চোখ বুজল ল্যানসো।
খানিক পরেই মেলল আবার। ম্লান আলোয় জ্বলজ্বল করছে চোখের তারা। নিজেকে যেন সান্তনা দিল, না, বোকামি করিনি। নতুন দুনিয়া খুঁজতে বেরিয়ে কলম্বাস কি বোকামি করেছিলেন? আমেরিকানরা যদি মনে করত, পশ্চিমে যাওয়া বোকামি, তাহলে কি গড়ে উঠত আজকের ইউনাইটেড স্টেটস? কনুয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল সে। জানো, কি বিরাট সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে এখানে? পৃথিবীর বৃহত্তম পতিত জায়গা এটা। এর বেশিরভাগ জায়গাতেই মানুষ যায়নি এখনও। খনিজ আর বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল। শুধু এই এক আমাজনই পৃথিবীর সব মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পারে। এখানে এখন প্রতি বর্গমাইলে একজনেরও কম মানুষ। নোক দরকার, বুঝেছ, অনেক লোক দরকার এখানে। আমাজনকে আবাদ করতে পারলে দুনিয়ার মানুষ আর না খেয়ে মরবে না। যারা এখানে আগে এসে বসত করবে, কাজের লোক হলে তাদের কপাল খুলে যাবে, আমি লিখে দিতে পারি।
ল্যানসোর কথাতেই বোঝা যায়, উচ্চশিক্ষিত।
ঠিক আছে, কথা পরে হবে, বলল কিশোর। আপনি এখন বিশ্রাম নিন।
শুয়ে পড়ল আবার ল্যানসো, কিন্তু কথা বন্ধ করল না, দুনিয়ায় কেন এত হাহাকার জানো? কেন শান্তি নেই? মূল সমস্যাটা হলো, ক্ষুধা। সেই ক্ষুধা মিটাতে পারবে আমাজন। আর সেটা মিটলেই পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসবে।
আপনি দুর্বল। ঘুমোন?
হাসি ফুটল ল্যানসোর ঠোঁটে। পাগলের প্রলাপ ভাবছ তো? সকালেই বুঝবে, মিছে কথা বলছি না আমি। এখনকার মাটিতে কি জাদু আছে বুঝবে।
পোড়া বেড়ার দিকে তাকাল কিশোর। ভেঙে ফেলা আসবাবের ওপর চোখ বোলাল। গান-র্যাক খালি, একটা বন্দুকও নেই, সব নিয়ে গেছে। ড্রয়ারগুলো শুন্য। বাক্স খালি। মানিব্যাগ ফাঁকা। ফতুর করে দিয়ে গেছে আপনাকে, বলল সে। এখানে থাকবেন কি করে আর?
চুপ করে রইল ল্যানসো।
আপনি শিক্ষিত লোক, কথা শুনেই বুঝেছি। কিছু মনে করবেন না, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, এখানে আসার আগে কি কাজ করতেন?
রিওতে কলেজের লেকচারার ছিলাম।
তাহলে আবার রিওতেই ফিরে যেতে পারেন। এখানে থেকে কি করবেন। নানা উটকো ঝামেলা, ডাকাত, ইনডিয়ান..এই ভীষণ জঙ্গলে একা কারও পক্ষে কিছু করা সম্ভব নাঃ..আমি আর কি বোঝাব? আপনিই আমাকে পড়াতে পারেন। এক কাজ করুন, কাল চলুন আমাদের সঙ্গে।
ল্যানসোর শুয়োরের খোঁয়াড় খালি, যা ছিল নিয়ে গেছে ভ্যাম্প। গোয়ালে একটা গরু নেই, জ্যান্ত নিতে পারেনি, জবাই করে মাংস নিয়ে গেছে।
কিন্তু বাগান নিয়ে যেতে পারেনি। ধান আর গমের খেত আছে, আছে সীম, লেটুস, শশা, গাজর, বাঁধাকপির বাগান।
পরদিন সকালে সে-সব দেখে তাজ্জব হয়ে গেল কিশোর। আমি তো ভেবেছিলাম, এত বৃষ্টি, মাটির রসকস কিছু নেই!
কিন্তু আছে যে, এখন তো বুঝতে পারছ? হাসল ল্যানসো। বরং অনেক বেশি আছে। দুনিয়ার চাষীদের সর্বক্ষণের চিন্তা-কি করে বেশি ফলাবে, বড় ফলাবে। এখানে এলে হয়তো ভাবতে শুরু করত, কি করে কম ফলিয়ে ফলন স্বাভাবিক রাখা যায়। এত বেশি ফলে, ঠেকিয়ে রাখা যায় না। রাতারাতি বেড়ে যায় ঘাসের জঙ্গল। রোজ নিড়ানি লাগে। বিশ্বাস করবে? এক রাতে এক ফুট বেড়ে যায় বাশের কোড়। ইউনাইটেড স্টেটসে শস্যের যে চারা বড় হতে দুই-তিন হপ্তা। লাগে, এখানে লাগে বড় জোর তিন দিন। আর দেখো, কমলার সাইজ দেখো।
হাঁ হয়ে গেল কিশোর। পাকেনি এখনও। এখনই ফুটবলের সমান একেকটা, এত ধরেছে, পাতা দেখা যায় না। এগুলো কমলা!
কমলা। এখান থেকে বীজ নিয়ে গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় চাষের চেষ্টা হচ্ছে। ফলছে ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই এত বড় করতে পারছে না। এর তিন ভাগের এক ভাগ বড় হয় ওগুলো।