দুজনেরই নাক এখন পানির তলায়। যে বেশিক্ষণ দম রাখতে পারবে, সে-ই জিতবে।
সাঁতারু, বিশেষ করে ডুবসাঁতারে মুসার চেয়ে দুর্বল পিঁপড়েখেকো, সুতরাং মাগেই দম ফুরাল। মরিয়া হয়ে নাক ভোলার চেষ্টা করতে লাগল সে। ঢিল হয়ে গেল বাহুর বাঁধন, বাঁচার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এখন জানোয়ারটা। নল ধরে রেখেই তার নিচ থেকে সরে এল মুসা, মাথা তুলল পানির ওপর।
দাপাদাপি কমে গেল পিঁপড়েখেকোর, ছটফট করছে শুধু এখন।
ইনডিয়ানরা সাহায্য করতে এগিয়ে এল।
ধরে ফেলা হলো পিঁপড়েখেকোকে। বেঁধে এনে তোলা হলো বড় বজরায়।
বালির চরায় চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে মুসা। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে।
তাড়াতাড়ি গিয়ে মলম আর আয়োডিন নিয়ে এল রবিন। মুসার ক্ষতগুলো পরিষ্কার করতে বসল।
দারুণ দেখিয়েছ হে, সেকেণ্ড, হেসে বলল কিশোর। স্কুলে গিয়ে বললে বিশ্বাসই করবে না কেউ।
প্রশংসায় খুশি হলো মুসা। ধরতে বলেছ, ধরে দিয়েছি, আমি আর কিছু জানি না। খাওয়ানোর দায়িত তোমাদের। ওর জন্যে রোজ চার-পাঁচ কেজি পিঁপড়ে জোগাড় করবে কে?
পিঁপড়ে লাগবে না, হাত নাড়ল কিশোর। চিড়িয়াখানায় মাংসের কিমার সঙ্গে কাঁচা ডিম মেখে খাওয়ায়। তা-ই খাওয়াব।
রাখবে কোথায়?
বজরাতেই। শান্ত স্বভাবের জানোয়ার। দুর্ব্যবহার না করলে রাগে না। দু দিনেই পোষ মেনে যাবে।
মরা জানোয়ারটাকে কেটে রান্না করল ইনডিয়ানরা।
কিশোর এক টুকরো মুখে দিয়েই থু থু করে ফেলে দিল।
মুখে দিয়ে মুখ বাঁকা করে ফেলল মুসা। এহহে, এক্কেবারে সিরকা। এর চেয়ে কাঁচা পিঁপড়ে খাওয়া সহজ।
রবিন মুখেই দিল না।
ইনডিয়ানরা খেলো। পিঁপড়েখেকোর মাংস নাকি রোগ সারায়।
.
০৫.
আগুন! আগুন! বনের দিকে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
আমাজনের কিনার দিয়ে চলেছে আবার বজরা-বহর।
ইনডিয়ানদের গাঁ জ্বলছে, অনুমানে বলল রবিন।
না, মাথা নাড়ল জিবা৷ বিদেশীর ঘর, রিও থেকে এসেছে। ফার্ম করেছে। ওখানে। বোধহয় ইনডিয়ানরা জ্বালিয়েছে।
এই, নৌকার মুখ ঘোরাও, নিদের্শ দিল কিশোর।
হাল ঘোরাল না জিবা। ইনডিয়ানরা যদি থাকে? ধরে কেটে ফেলবে।
জলদি ঘোরাও, জিবার কথা কানেই তুলল না কিশোর। আগুন নেভাতে হবে। জলদি।
কথা শুনল না জিবা। আগের মতই হাল ধরে রইল।
মঞ্চে উঠে ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে হাল ধরল মুসা। ঘুরিয়ে দিল নৌকার গলুই।
বিড়বিড় করতে করতে মঞ্চ থেকে নেমে এল জিবা।
তীর থেকে কয়েক ফুট দুরে নোঙর ফেলা হলো। মাটিতে গলুই ঠেকিয়ে। রাখলে বন্দিরা পালাতে পারে, সেজন্যে এই সতর্কতা।
তীরে নামল সবাই। কিশোর আর রবিনের হাতে বন্দুক, মুসার হাতে রাইফেল। ইনডিয়ানদের হাতে তীর-ধনুক, রো-গান আর বল্লম। জিবার হাতে বিশাল এক ছুরি।
চলার সময় খালি পেছনে পড়ছে সে। নৌকার দড়ি কেটে নৌকা নিয়ে পালানোর মতলব আঁটছে বোধহয়। সতর্ক রয়েছে কিশোর। লোকটাকে চোখের আড়াল করল না।
কিন্তু দেরি করিয়ে দিচ্ছে জিবা। শেষে বিরক্ত হয়ে তাকে সবার সামনে ঠেলে দিল কিশোর। তুমি আগে থাকো। জোরে হাঁটো।
গোঁ গোঁ করে প্রতিবাদ জানাল জিবা। কিন্তু কান দিল না কিশোর।
খানিক দূর এগোতেই আগুন আরও ভালমত দেখা গেল। বালতি নিয়ে। ছোটাছুটি করছে একজন লোক, কুয়া থেকে পানি এনে আগুনে ছিটাচ্ছে। কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
জিবার পিঠে বন্দুকের নল দিয়ে খোঁচা মেরে বলল কিশোর, দৌড় দাও।
দৌড়ে এগোল সবাই।
একদল সশস্ত্র লোক দেখে চমকে কোমরের কাছে হাত দিল তরুণ লোকটা, হতাশ হলো। রিভলভার থাকার কথা, কিন্তু নেই।
বালতি-টালতি আর আছে? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ভয় চলে গেল লোকটার চেহারা থেকে। ইংরেজিতেই জবাব দিল, ওই যে, ওখানে আছে। একটা চালাঘর দেখাল।
যে যা পারল-বালতি, ড্রাম, মগ তুলে নিয়ে কুয়ায় ছুটল সবাই।
গোটা দুই চালা জ্বলে শেষ। বড় ঘরটায় আগুন ধরেছে। পানি নিয়ে ওটা বাঁচাতে ছুটল। টিনের চাল, গাছের বেড়া, তাই ঘরের আগুন দ্রুত ছড়াতে পারল না। নিভিয়ে ফেলা গেল।
হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে ঢুকল লোকটা। এক দিকের বেড়া পুড়েছে, ঘর কালিতে মাখামাখি। ছাইয়ে ভরা মেঝেতেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে।
ধরাধরি করে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিল তিন গোয়েন্দা। হারিকেন জ্বালল। প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইল লোকটা, চোখ বন্ধ। জখম-টখম আছে কিনা, পরীক্ষা করে দেখল কিশোর। না, তেমন কোন জখম নেই। বেশি পরিশ্রমে কাহিল হয়ে গেছে।
দৌড়ে গিয়ে কুয়া থেকে তোয়ালে ভিজিয়ে আনল মিরাটো।
ভেজা তোয়ালে ভাঁজ করে লোকটার কপালে বিছিয়ে দিল কিশোর।
আস্তে করে চোখ মেলল লোকটা। চোখা চেহারা। চোখে বৃদ্ধির ছাপ। ফ্যাকাসে মুখে হাসি ফুটল। নড়ে উঠল ঠোঁট, থ্যাংকস।
এক গেলাস খাবার পানি নিয়ে এল রবিন।
লোকটার মাথার নিচে হাত দিয়ে ধরে তুলে আধশোয়া করল মুসা।
রবিনের হাতে গেলাস রেখেই পানি খেলো লোকটা। সোজা হয়ে বসে ঘরের চারদিকে চোখ বোলাল। সব কিছু এলোমেলো, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বাক্সগুলো মেঝেতে পড়ে আছে, খালি। আলমারির দরজা খোলা, তাক খালি। ভেতরের কিছু কিছু জিনিস ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। বোঝা গেল, ডাকাতি হয়েছে। লুট করে নিয়ে গেছে জিনিসপত্র। মূল্যবান কিছুই রেখে যায়নি ডাকাতরা। মেঝেতে আর কিছু কাগজে রক্তে লেগে আছে।