খাল দিয়ে বেরিয়ে এসে আবার চওড়া নদীতে পড়ল বজরা-বহর। প্রায় পাঁচ মাইল চওড়া এখানে নদী। সামনে আরও চওড়া হয়েছে। যেন অকুল পাথর। মাঝে একটা দ্বীপও আর চোখে পড়ছে না। দিনের বেলা এই খোলা নদীতে রাইফেলের সহজ নিশানায় পরিণত হবে ওরা।
উষার আগমন ঘোষণা শুরু করল পাশের জঙ্গলের পশু পাখি। পুব আকাশে মলিন হয়ে এল তারার আলো। ধূসর, ঠাণ্ডা আলো ফুটতে শুরু করেছে দিগন্তরেখা বরাবর। তার খানিক ওপরে মেঘের গায়ে রঙের ছোঁয়া লাগল, গাঢ় থেকে গাঢ়তর। হলো লাল, তারপর হঠাৎ করে যেন ঝাপি খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে এল টকটকে লাল। সূর্য।
বজরা-বহরের পেছনে দূরে কালো একটা বিন্দু দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয় ভ্যাম্পের মনট্যারিয়া। ওটা যখন এরা দেখতে পাচ্ছে, ওদের জন্যে বজরা-বহর দেখতে পাওয়াটা আরও সহজ।
চওড়া হওয়া যেন শেষ হবে না নদীর। এখনই এক তীর থেকে আরেক তীর দশ মাইল হয়ে গেছে।
ম্যাপ দেখল কিশোর। সামনে এক গুচ্ছ দ্বীপ থাকার কথা, তার পরে আবার খোলা নদী। এক জায়গায় নীল মোটা একটা রেখা মূল ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে একেবেঁকে গেছে। নদী একখান থেকে ঢুকেছে ডাঙার ভেতরে, আরেকখান দিয়ে বেরিয়ে আবার পড়েছে নদীতে।
ওখানে কি আছে জিবাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কিছু নেই, মাথা নাড়ল জিবা। তোমার ম্যাপ ভুল। থাকলে, জানতাম।
কিন্তু এই ম্যাপ ভুল হতে পারে না, তর্ক করল কিশোর। আমেরিকান জিওগ্রাফিক্যাল
বুঝতে চাইল না জিবা। তার এক কথা, ম্যাপ ভুল।
কিন্তু শেষে দেখা গেল, জিবাই ভুল করেছে। চওড়া খালটা পাওয়া গেল। কিশোরের নির্দেশে তাতে ঢুকে পড়ল বজরা-বহর। দুই ধারে জঙ্গল এত ঘন, ভ্যাম্পের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে, যদি না তার কাছেও এ-রকম একটা ম্যাপ থেকে থাকে।
পানির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় গাছ। খাড়া উঠে গেছে দুশো ফুট। তারপর দু-দিক থেকে এসে মিশেছে দুদিকের ডালপালা, মাথার ওপরে ছাত তৈরি করে দিয়েছে। সেই ছাতকে জীবন্ত করে রেখেছে বানরের দল আর রাশি রাশি পাখি-চোখ ধাঁধানো রঙ।
বাতাস নেই এখানে। পাল তুলে রাখার আর কোন মানে হয় না। নামিয়ে ফেলা হলো। পানিতে ঢেউও নেই, কাঁচের মত স্বচ্ছ। দাঁড় বাওয়া সহজ।
এগিয়ে চলেছে বজরা বহর, ভেসে থাকা কুমিরের নাকে ঢেউ লাগছে, বিচিত্র। শব্দ করে তলিয়ে যাচ্ছে ওগুলো। এক জায়গায় ধ্যানমগ্ন হয়ে ছিল দুটো জ্যাবিরু। সারস, নৌকা দেখে ধ্যান ভাঙল। এক পায়ের জায়গায় দুই পা দেখা দিল। পাশ। দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের সঙ্গে কথা বিনিময় হলো লম্বুর।
আরি! দেখো দেখো! আঙুল তুলে দেখাল মুসা। পানির ওপর দৌড়াচ্ছে গিরগিটি।
দাঁড় বাওয়া থামিয়ে অদ্ভুত জীবটাকে দেখল সবাই। লেজসহ ফুট তিনেক, লম্বা। পেছনের দুই পা আর লেজের ওপর ভর, সামনের দুই পা তুলে রেখেছে অনেকটা মোনাজাতের ভঙ্গিতে।
ব্যাসিলিস্ক, বলল কিশোর।
অনেক দাম, রবিন বলল। ধরতে পারলে কাজ হয়।
কিন্তু ধরা কঠিন। পানির ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে একপাড় থেকে আরেক পাড়ে, আবার আসছে এ-পাড়ে, খাবার খুঁজছে। আসছে-যাচ্ছে। নৌকার সামনে দিয়েই। কারও দিকে খেয়াল নেই, নিজের কাজে ব্যস্ত।
আরেকবার নৌকার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ঝাঁপ দিল মিরাটো। পড়ল গিরগিটিটার ওপর। তলিয়ে গেল। খানিক পরে আবার যখন ভেসে উঠল, দেখা গেল তার হাতে ছটফট করছে ব্যাসিলিস্ক।
গলায় দড়ি লাগিয়ে বড় বজরার টলডোর ভেতরে একটা খুঁটিতে বেঁধে রাখা। হলো জীবটাকে। বাধা না থাকলে ঝামেলা করে, তাই মোট চারটে জীবকে বেঁধে রাখা হয়েছে এখন। লম্বুর ঠ্যাঙ-এ শুরু থেকেই দড়ি ছিল, বোয়ার সঙ্গে গোলমাল। করার পর নাকু আর ডাইনোসরের গলায় দড়ি পড়েছে।
খালটা আট মাইল লম্বা। শেষ হলো একটা মোহনায়-ন্যাপো আৰু আমাজনের মিলনস্থল।
ভ্যাম্প পিছে পিছে খাল ধরে আসছে কিনা, জানে না কিশোর। সরাসরি আমাজন ধরে আর যেতে চাইল না। তার চেয়ে বায়ে-মোড় নিয়ে ঢুকে যাবে ন্যাপো নদীতে। খোলা আমাজন ধরে গেলে ডাকাতদের চোখে পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
নদীটার বড় একটা বাঁক ঘুরতেই গাছপালা আড়াল করে ফেলল বজরা বহরকে। আমাজন থেকে আর দেখা যাবে না।
আরও খানিক দূর এগিয়ে শান্ত একটা বাকের কাছে নৌকা বাঁধার নির্দেশ দিল, কিশোর। দিনটা ওখানেই কাটাবে।
তীর ঘেঁষে নৌকা রাখলে বোয়া নেমে যেতে পারে, তাই রাখা হলো বিশ ফুট দূরে। কিন্তু এত দূরেও গভীরতা বড়ই কম, মাত্র হাঁটু পানি ওখানে। নিচে নরম. বালি। কাদা নেই। পানি ভেঙে সহজেই হেঁটে গিয়ে ওঠা যাবে ডাঙায়।
আগে নামল মুসা। ডাঙায় উঠল। এবং উঠেই জড়াল গোলমালে।
.
০৪.
হাঁ হয়ে গেছে মুসা। চোখ ডলল। বিশ্বাস করতে পারছে না, এ-রকম জীব আছে। দুনিয়ায়, ওই চেহারার!
ভালুকের মত পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। শরীরটাও গলা পর্যন্ত ভালুকের মত। কিন্তু গলার ওপরে…কিসের সঙ্গে তুলনা করবে? শুড়? না। নাক? তা-ও না। মাথা নেই, মুখ নেই, চোয়াল নেই। মোটা একটা নল যেন ঘাড়ের সঙ্গে
জুড়ে দেয়া হয়েছে, আগাটা সরু, তাতে গোল ছিদ্র। সেটা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে। বেরোচ্ছে লকলকে…হ্যাঁ, বোধহয় জিভই।
পেশীবহুল বিশাল দুই শক্তিশালী বাহু, থাবা কিংবা আঙুল নেই, তার জায়গায় রয়েছে ইঞ্চি চারেক লম্বা বাঁকা নখ। ওই নখ দিয়ে মানুষের সমান উঁচ, কঠিন উইয়ের ঢিবি এত সহজে চিরছে, যেন ছুরি দিয়ে মাখন কাটছে। পিলপিল করে বেরোচ্ছে। উই।দুই ফুট লম্বা, লাল, সাপের জিভের মত জিভে আটকে পোকাগুলোকে নলের ভেতরে চালান করছে জীবটা। নাক-মুখ দুয়েরই কাজ করে তার নল।