কেউ বাঁচাতে গেল না তাকে। পালের দড়ি বাধা হয়ে গেছে বজরা-বহরের। ঝপাত করে পানিতে পড়ল দাঁড়। উল্টানো ক্যানূটার পাশ দিয়ে ধেয়ে বেরোল নৌকা।
পেছনে বড় নৌকাটায় চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। স্প্যানিশ আর পর্তুগীজ শব্দ কম, বেশির ভাগই অশুদ্ধ ইংরেজি। ডাকাতগুলোকে বোধহয় ইকিটোজ থেকেই জোগাড় করেছে ভ্যাম্প। তাদের মাঝে একজন কি দু-জন রয়েছে ইনডিয়ান কিংবা ক্যাবোকো, যে নদীপথ চেনে। বাকিগুলো সব আনাড়ি। দক্ষ জাহাজ হতে পারে। কিন্তু নদীপথে দাঁড় বেয়ে নৌকা চালানো এক কথা, আর সাগরে এঞ্জিনের জাহাজ চালানো আরেক।
বোঝা যাচ্ছে দাঁড় বাওয়া দেখেই। মনট্যারিয়া নিয়ে ধাওয়া করেছে। দুই ধারে চারজন করে দাড়ি। বেশি ভিড় বলা যাবে না। কিন্তু এতেই গোলমাল করছে ওরা, দাড়ে দাড়ে লাগিয়ে দিচ্ছে, ফলে ব্যাহত হচ্ছে নৌকা বাওয়া। একে অন্যকে দোষ। দিচ্ছে, গালাগাল করছে মুখ খারাপ করে।
পানিতে পড়া দু-জনকে ভোলার জন্যে থামতে হলো ভ্যাম্পকে। ক্যাটা সোজা করে বাধল মনট্যারিয়ার সঙ্গে। সময় নষ্ট হলে তাতে।
থ্যাংকিউ, মুসা, এতক্ষণে বলল কিশোর।
মুসা বুদ্ধি করে সাপের ঝুড়ি ফুড়ে মারাতেই বেঁচেছে ওরা। কিন্তু স্বস্তি বেশিক্ষণ থাকল না। ঝাকে ঝাকে বুলেট ছুটে এল মনট্যারিয়া থেকে। প্রচণ্ড রাগে যেন এলোপাতাড়ি ছুটতে লাগল। শক্তিশালী রাইফেল, শব্দ শুনেই বোঝা যায়। পাঁচশো ফুট দূরত্ব কিছুই না ওগুলোর জন্যে।
বড় বজরার গলুইয়ের কাছে কাঠের চলটা ওঠাল একটা বুলেট, টলজের ছাত কুঁড়ে গেল একটা, আরেকটা এসে ভেঙে দিল মঞ্চের এক পা। বেকায়দা ভঙ্গিতে সামান্য কাত হয়ে গেল মঞ্চটা। হাল ছেড়ে লাফ দিয়ে নেমে এল জিব।
শাঁই করে নাক ঘুরে গেল বড় বজরার।
ধমক দিয়েও জিবাকে আর পাঠানো গেল না মঞ্চে।
তোতলাচ্ছে জিবা, কি বলল বোঝা গেল না। নাকমুখ গুঁজে গিয়ে টলডোর ভেতরে পড়ল।
দাঁড় ফেলে লাফিয়ে গিয়ে টলোতে উঠল মুসা। ছুটে গিয়ে চড়ল মঞ্চে। হাল ধরে নৌকার মুখ সোজা করল আবার। কিন্তু ইতিমধ্যে মহামূল্যবান খানিকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে।
তার চারপাশে বুলেট ছুটছে। আকাশ আর তারার পটভূমিকায় বেশ স্পষ্ট নিশানা এখন সে। যে কোন মুহূর্তে এসে পিঠে বিধতে পারে গুলি। কিন্তু পরোয়া করল না। হাল ধরে না রাখলে বজরা-বহরের সবাইকে মরতে হবে। এখন তাকে দেখলে কে বলবে এই সেই ভুতের ভয়ে-কাব স্বভাবভীতু মুসা আমান?
কিশোর! চেঁচিয়ে বলল মূসা, ক্যানূর দড়ি কাটতে বলো।
কেন… বলেই থেমে গেল কিশোর। বুঝতে পেরেছে।
মিরোটাও পেরেছে। ছুরি হাতে ছুটে গেল সে।
সরু খালে পঁচিশ ফুট লম্বা ক্যান্ আড়াআড়ি পড়ে থাকলে ওটা না সরিয়ে কোন নৌকা এগোতে পারবে না।
দড়ি ধরে টেনে ক্যানূটাকে কাছে নিয়ে এল মিরাটো। কয়েক পোচেই দড়ি কেটে ফেলল। ক্যানূর গলুই ধরে ধাক্কা লাগাল জোরে। আধ চক্কর ঘুরে আড়াআড়ি হয়ে গেল ক্যানূ। ভাসতে লাগল খাল জুড়ে।
মিনিটখানেক দেরি করাবে, বিড়বিড় করল মু
সা। তার কথার জবাবেই যেন ছুটে এল বুলেট। প্যান্টের হাটুর ওপরে কাপড়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল উরু। মনে মনে বলল, আল্লা, ক্যানূটা যেন না দেখে।
সময়মত চোখে না পড়লে জোরে এসে তাতে ধাক্কা খাবে মনট্যারিয়ার গলুই, ভেঙে যাওয়ার মোনলা আনা সম্ভাবনা।
সময়মতই দেখল ভ্যাম্প, কিন্তু বেশি মাতব্বরী করতে গিয়ে পড়ল বিপাকে। সময় নষ্ট হবে, তাই ক্যানূ না সরিয়ে ওটার এক গলুই ঠেলে সরিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল। আসতে পারত, যদি মাল্লারা আনাড়ি না হত।
বুনো চিৎকার করে উঠল নৌকা বোঝাই ডাকাতেরা। তাদের চিৎকার ছাপিয়ে শোনা গেল আরেকটা কন্ঠ, পর্তুগীজ ভাষায় হুঁশিয়ার করছে। বোধহয় ইনডিয়ান, যে এই এলাকা চেনে। পানিতে দাঁড়ের খোঁচা মেরে মনট্যারিয়াকে সরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করল ওরা। পারল না। বালির চরায় নৌকার তলা ঘষা খাওয়ার তীক্ষ্ণ খচখচ শব্দ দূর থেকেও শোনা গেল। কাত হয়ে গেল নৌকা। পালের জন্যে আরও বেশি কাত হয়ে পানিতে ডুবে গেল একটা পাশ। মাল্লাদের কিছু চরায় ছিটকে পড়ল, কিছু পানিতে।
জোরে! মঞ্চ থেকে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। জোরে টানো দাঁড়। পালানোর এই সুযোগ।
গুলি বন্ধ হয়েছে দেখে আবার গিয়ে হাল ধরল জিবা।
অন্ধকারে আঁকাবাঁকা খাল ধরে তীব্র গতিতে ধেয়ে চলল বজরা-বহর। ধীরে ধীরে পেছনে পড়ল ডাকাতদের উত্তেজিত চেঁচামেচি, একটা সময় আর শোনা গেল না।
হাঁপ ছাড়ল নৌকার সবাই।
কিন্তু এই অবস্থা বেশিক্ষণ থাকবে না, জানে কিশোর। নৌকা সোজা করে নিয়ে খানিক পরেই আবার ছুটে আসবে ভ্যাম্পের দল। যত খারাপ মাল্লাই হোক, ওরা সংখ্যায় বেশি। তাছাড়া মনটারিয়া হালকা নৌকা। ভারি ব্যাটালাওয়ের চেয়ে দ্রুতগতি। তার ওপর ব্যাটালাও একা চলছে না, টেনে নিতে হচ্ছে আরেকটা নৌকাকে। বোঝা তো আছেই।
কাজেই, ভ্যাম্পের নৌকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বজরা-বহরের পারার কথা নয়।
পালের ওপর বিশেষ ভরসা নেই। অনুকূল হাওয়া না থাকলে পাল অকেজো। আর খালি যদি সামনে ছোটার ব্যাপার হত, এক কথা ছিল। পথে পথে থামতে হবে। তাদেরকে, জানোয়ার ধরার জন্যে। ধরতেই যদি না পারল, এই অভিযানই বৃথা।
যা উঁচু মাস্তুল, লুকাবে কোথায় নৌকাদুটোকে?