অবশ হয়ে গেল আবার বোয়া।
গেছে, পাওয়া গেছে। আনন্দে আরও জোরে টিপে ধরল মুসা।
পাটাতনে ফেলে সাপটাকে চেপে ধরল সবাই। ঠিক কোন জায়গায় চাপ দিতে হয়, জেনে গেছে মুসা। অজিলের চাপ সরাচ্ছে না।
ধরলাম তো,হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। রাখি কই?
আঙুল তুলে মনট্যারিয়ার টলডো দেখাল জিবা।
তা-ই করা হলো। সাপটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে টলডোতে ভরে দরজা আটকে দেয়া হলো।
হ্যাঁ, বেশ ভাল জায়গা পেয়েছে, বলল কিশোর।
বড় বজরার পাটাতনে, টলডোর হাতে জিরাতে বল সবাই। একটিমাত্র সাপ ঘাম ঝরিয়ে ছেড়েছে এতগুলো লোকের।
আরিব্বাপরে, এত শক্তি! ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে মুসা। টলডোর বেড়া ভেঙে না পালায়।
না, তা বোধহয় করবে না, রবিন বলল। পানিকে ভয় পায়। তবে বলাও যায় না। শান্ত করে ফেলা দরকার।
শান্ত? মুখ তুলল মুসা। কিভাবে?
পেটে খিদে ওটার, জবাব দিল কিশোর। পেট ভরাতে হবে। তাহলেই দিন। কয়েকের জন্যে চুপ।
বোয়ার খাবারের সমস্যা নেই। বুনো জানোয়ার চলাচলের পথে মাটিতে গর্ত করে ফাঁদ পেতে সহজেই একটা অল্প বয়েসী পেকারি ধরে নিয়ে এল ইনডিয়ানরা। টলডোর দরজা খুলে জানোয়ারটাকে ভেতরে ঠেলে দিয়েই আবার বন্ধ করে দিল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল পেকারির আতঙ্কিত আর্তনাদ। দ্রুত কমে এল চিৎকার, তারপর চাপা গোঙানি, অবশেষে তা-ও বন্ধ হয়ে গেল।
টলডোর দরজা খুলে সাবধানে উঁকি দিল মিরাটো। এক নজর দেখে ইশারায় ডাকল কিশোরকে। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
বোয়ার বিশাল হাঁয়ের ভেতরে অর্ধেক ঢুকে গেছে পেকারি।
খাইছে। মুসা অবাক। এত বড়টা ঢোকাল কিভাবে?
চোয়ালের গোড়া আলাদা ওদের, বোঝাল কিশোর। আমাদের চোয়ালের মত নয়। ওপরের আর নিচের চোয়ালের মাঝে ইলাসটিকের মত জিনিস রয়েছে, ইচ্ছে করলেই অনেক বেশি ছড়াতে পারে চোয়াল।
দেখতে দেখতে পেকারিটাকে গিলে ফেলল বোয়া।
মারছে। মাথা নাড়ল মুসা। ওই রাক্ষসের জন্যে রোজ খাবার জোগাড় করবে কে?
ভয় নেই, রোজ লাগে না, রবিন বলল। ওই এক পেকারিতেই ওর এক হপ্তা চলে যাবে। দুই হপ্তাও যেতে পারে। ওর রাগ-টাগ সব শেষ। চুপচাপ গিয়ে এখন অন্ধকার কোণে শুয়ে পড়বে। সাত চড়েও আর রা করবে না। পড়ে পড়ে ঘুমাবে। খিদে পেলে তারপর জাগবে।
ঠিকই বলেছে রবিন।
খাওয়া শেষ হতেই টলভোর কোণের দিকে রওনা হলো বোয়া। সুবিধেমত একটা জায়গা বেছে নিয়ে কুণ্ডলী পাকাল। মাথাটা কুণ্ডলীর ওপরে রেখে চুপ হয়ে গেল। আবছা অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে, বেমক্কাভাবে ঢোল হয়ে ফুলে থাকা পেটটা, ওখানেই রয়েছে পেকারি।
পরের সারাটা দিন বোয়ার আর কোন সাড়াই পাওয়া গেল না।
এই সময়ে আরেক কাণ্ড হয়েছে। বনের ভেতরে শিকারের খোঁজে গিয়েছিল মিরাটো আর দুজন ইনডিয়ান। ঝুড়িতে ভরে নিয়ে এসেছে, আরও ডজনখানেক সাপের বাচ্চা। একটা বোয়ার বাসা পেয়ে গিয়েছিল, তাতেই ছিল বাচ্চাগুলো।
খুশি হলো কিশোর। বোয়ার বাচ্চারও নেহায়েত কম চাহিদা নয়। বারোটা বাচ্চার অনেক দাম।
অন্ধকার ঘনালে রওনা হলো বজরা-বহর।
মাঝরাতের দিকে অনুকুল হাওয়া পেয়ে পাল তোলা হলো। আশপাশের জঙ্গল নীরব। সরু একটা প্রণালীর ভেতর দিয়ে চলেছে এখন তিনটে নৌকা। এক পাশে মূল ভূখণ্ড, আরেক পাশে ছোট একটা দ্বীপ।
হঠাৎ সামনের আবছা অন্ধকারের চাদর ফুড়ে বেরোল যেন নৌকাটা, একটা ক্যানূ। পর্তুগীজ ভাষায় চিৎকার শোনা গেল, মনে হলো সাহায্যের আবেদন। সন্দেহ হলো কিশোরের-ফাঁদ নয়তো? কিন্তু সত্যি যদি বিপদে পড়ে থাকে লোকটা? পাল নামানোর নির্দেশ দিল সে।
ক্যানূর পাশাপাশি হলো বড় বজরা।
কিশোর প্যাশাআ (পাশা)? ক্যানূ থেকে বলল একটা কণ্ঠ।
হ্যাঁ, সন্দেহ বাড়ল কিশোরের। নাম জানল কিভাবে? ক্যান্তে মাত্র দু-জন লোক
ওরাই। অদৃশ্য কারও উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল ক্যানূর একজন।
তীরের কাছে অন্ধকার থেকে সাড়া এল। পানিতে একসাথে অনেক দাঁড়। ফেলার ছপছপ শব্দ।
পাল! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। জলদি!
কিন্তু পালের দড়িতে হাত দেয়ার আগেই ক্যানূর একজন ঝুঁকে বড় বজরার কিনারা আঁকড়ে ধরল। হাতের রিভলভার নেড়ে বলল, খবরদার! নড়লেই মরবে!
পাথর হয়ে গেল যেন ইনডিয়ানরা।
সাপের ঝুড়িটার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুসা। জায়গাটা অন্ধকার। তাকে দেখা যাচ্ছে না।
এগিয়ে আসছে দাড়ের শব্দ। যা করার এখুনি করতে হবে। আস্তে ঝুঁকে সাপের বাচ্চা ভরা ঝুড়িটা তুলে নিল সে।
নৌকাটা আবছা দেখা যাচ্ছে এখন। বেশ বড়। তাতে অনেক লোক। নিশ্চয় ভ্যাম্প আর তার দলবল।
আর দেরি করল না মুসা। দুহাতে ধরে ঝুড়িটা মাথার ওপরে তুলে ছুঁড়ে মারল ক্যানূর দুজনকে লক্ষ্য করে।
.
০৩.
ঝুড়ির মুখ খুলে গিয়ে মাথার ওপর যেন সর্পবৃষ্টি হলো।
কি সাপ, বিষাক্ত কিনা, কি করে জানবে ওরা? মাথা ঢাকার জন্যে হাত উঠে গেল ওদের। ট্রিগারে আঙুলের চাপ লেগে গুলি ফুটল। কিন্তু কারও কোন ক্ষতি। করল না বুলেট, আকাশমুখো উড়ে গেল। আতঙ্কে চেঁচাচ্ছে ক্যানূতে বসা লোকটা, থাবা দিয়ে গা থেকে সরাচ্ছে কিলবিলে জীবগুলোকে।
বড় বজরার কিনার থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে অন্যজন। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল পানিতে, কাত করে ফেলল ক্যানূ। অন্য লোকটাও পানিতে পড়ল।
বাঁ-ব্বাচাও! হাত ছুঁড়ছে একজন। আ-আমি সাঁতার জানি না..প্লুপ!