দেখো ভাই, আমাকে ভুল বুঝছ তোমরা তোমাদের নৌকা আর জানোয়ারগুলোকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম কেবল। ভাল কাজ দেখিয়েছি, তাই না? একটা জানোয়ারও মরেনি। সব ঠিক আছে।
তা আছে। মানুষের মত রোজ রোজ খাবার লাগে না বলেই বেচে আছে, নইলে কবে মরে ভূত হয়ে যেত। তুমি কি খাওয়ানোর মানুষ? দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, চলো, অনেক কাজ পড়ে আছে। এটার সঙ্গে বকরক করে লাভ নেই।
আবার রেগে উঠল ভ্যাম্প। গালাগাল শুরু করল। আওয়াজে সাপটা নড়েচড়ে উঠতেই ভয় পেয়ে থেমে গেল।
জানোয়ারগুলোকে খাওয়াতে লাগল তিন গোয়েন্দা। ওগুলোর হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে, কিছু খাওয়ায়নি ভ্যাম্প।
খা, রক্ত গরম করে রক্তচাটাকে দিতে দিতে বলল কিশোর। এই শেষ। ম্যানাওয়ে পৌঁছার আগে আর পাবি না।
এত কাছে চলে এসেছি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
হ্যাঁ। বাতাস পেলে কালই পৌঁছে যাব।
দুপুরের পর ভাটিয়াল বাতাস শুরু হলো, বাড়ল স্রোতের বেগ। দ্বীপটা চলতে, শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটাও। লগি দিয়ে ঠেলে দ্বীপের গা থেকে নৌকাটাকে ছুটাল তিন গোয়েন্দা। দাঁড় বেয়ে এনে ফেলল মূল স্রোতে। পাল তুলে দিতেই তরতর করে ছুটে চলল নৌকা।
জ্বর ছেড়েছে, পেট ভরে খেয়েদেয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছে মুসা। মঞ্চে উঠে হাল ধরে বসল। গান ধরল গুনগুন করে।
সমস্তটা দিন নানারকম ভাবে ছেলেদের মন গলানোর চেষ্টা করল ভ্যাম্প। ফিরেও তাকাল না ওরা। একবার বিশ্বাস করেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।
বকাবাহ্যি করে কাহিল হয়ে খাঁচার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল ভ্যাম্প। বড় বড় হাই তুলছে, কিন্তু সাপের ভয়ে চোখ বন্ধ করছে না। ঘুমোলেই যদি সুযোগ পেয়ে তাকে গিলে ফেলে অ্যানাকোণ্ডা।
সাঁঝের বেলা নৌকা পাড়ে ভেড়ালো ছেলেরা। ঘাসে ঢাকা খানিকটা খোলা জায়গা, ক্যাম্প করল সেখানেই।
আগুন জ্বেলে খাবার গরম করে খেল। ভ্যাম্পকেও দিল।
ঠিক হলো, পালা করে পাহারা দেবে রাতে। ভ্যাম্পকে বিশ্বাস নেই। খাঁচার বেড়া খুলে বেরিয়ে আসাটা তেমন কঠিন কিছু না।
হুশিয়ার করল কিশোর, চুপ করে শুয়ে থাকো। শয়তানী করতে চাইলেই খোচ দিয়ে জাগিয়ে দেব সাপটাকে।
চোখের আগুনে তাকে ভস্ম করার জোর চেষ্টা চালাল ভ্যাম্প। তবে চুপ করে। রইল।
সকালে উঠে নাস্তা সেরে আবার নৌকা ছাড়ল ওরা।
দুপুরের আগে নদীর পানির রঙ বদলে গেল, এতদিন ছিল বাদামী, হয়ে গেল। কালো। তার মানে ওখানে আমাজনের সঙ্গে মিলিত হয়েছে কালো নদী রিও নিগ্রো।
আর দশ মাইল, বলল কিশোর। নৌকার মুখ ঘোরাতে বলল মুসাকে।
আমাজন থেকে সরে এসে রিও নিগ্রোতে ঢুকল নৌকা। এগিয়ে চলল জঙ্গল শহর ম্যানাওয়ের দিকে। অনেক বছর আগে রবার চাষের স্বর্ণযুগে তৈরি হয়েছিল শহরটা, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে হাজার মাইল দূরে। এখন হয়ে গেছে বড় বন্দর।
ছোট-বড় অসংখ্য জলযান দেখতে পেল ছেলেরা। মাল নিয়ে বড় বড় মালবাহী স্টীমার যায় উত্তর আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ওগুলোর। পাশে বিরাট বজরাটাকে নগণ্য লাগল। গ্লাসগো থেকে আসা একটা দানবীয়। জাহাজের পাশে জেটিতে নৌকা বাঁধল ছেলেরা।
নানারকম জন্তু-জানোয়ার, আর বিশেষ করে অ্যানাকোণ্ডার খাঁচায় ডাকাতে চেহারার বন্দি একজন মানুষ দৃষ্টি আকর্ষণ করল লোকের। ভিড় করে দেখতে এল ওরা।
নৌকা পাহারায় রইল মুসা আর রবিন। কিশোর চলল থানায়।
থানার ইনচার্জকে সব খুলে বলল সে।
প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে চাইলেন না ইন্সপেক্টর। শেষে বললেন, একটা কাজের কাজই করেছ। চেহারার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, গাই ক্যাশার। কয়েকটা। ডাকাতি আর খুনের মামলার আসামী, হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকে পুলিশ। বছর দুই তার কোন খোঁজ পাইনি। শেষবার দেখা গিয়েছিল কোকামায়। লোক দিচ্ছি, নিয়ে যাও সঙ্গে। ধরে নিয়ে আসবে ব্যাটাকে।
খাঁচা থেকে খুলে ভ্যাম্পের হাতে হাতকড়া পরাল পুলিশ।
স্টীমার অফিসে গেল এরপর কিশোর। জাহাজে নিজেদের জন্যে কেবিন আর জানোয়ারগুলোর জন্যে জায়গা ভাড়া করল।
জাহাজ ছাড়বে তিন দিন পরে।
এই কটা দিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটল তিন গোয়েন্দার। ভাল খাঁচা বানানো, ওগুলোতে জানোয়ারগুলোকে সরানো, জাহাজে ভোলা, অনেক কাজ।
নির্দিষ্ট দিনে জাহাজ ছাড়ল।
রেলিঙে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। কালো নদীর কালো পানি দিয়ে ছুটে চলেছে জাহাজ।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
কি ভাবছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
ভাবছি, জানোয়ার ধরতে এরপর কোথায় যাব।
আদৌ যাওয়া হবে কিনা কে জানে। মা কি আর যেতে দেবে?
হবে না কেন? রবিন বলল। ব্যবসা যখন, দেবে। তাছাড়া, এবার তো সাকসেসফুল হয়েছি আমরা।
বাবার কি অবস্থা, কে জানে? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। বাবা ভাল হলে যাওয়ার অসুবিধে হবে না। এরপর আফ্রিকা যাব আমরা।
পাড়ের গভীর অরণ্যের দিকে চেয়ে নীরবে মাথা দোলাল শুধু কিশোর।