রকফেলার ল্যাবরেটরিতে দেখেছি, বড় বড় বাইনকে লেজ ধরে পানি থেকে তুলছে। অবাক হয়েছি। জিজ্ঞেস করে জেনেছি, লাইন কেটে বিদ্যুৎ চলাচল বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে ওগুলোর। ডায়নামোটা থাকে বাইনের মাথায়। লম্বা একটা নার্ভ ওখান থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত চলে যায়। ওই নার্ভের কোন জায়গায় কেটে দিলে তার নিচের দিকে আর বিদ্যুৎ যেতে পারে না। তখন ওখানে ধরলে আর অসুবিধে। নেই।
এক্সপেরিমেন্ট করবে?
হ্যাঁ, বলতে বলতেই লাঠির এক খোঁচায় বাইনটাকে ডাঙায় তুলে ফেলল, কিশোর। লাঠি দিয়ে চেপে ধরল লেজের ছয় ইঞ্চি ওপরে। রবিনকে বলল, ধরো তো, লাঠিটা শক্ত করে ধরো।
ছুরি বের করল সে। কাঠের হাতল, বিদ্যুৎ-নিরোধক। এক পোচে কেটে ফেলল বাইনের নার্ভ যে জায়গায় থাকার কথা সেখানটা। সাবধানে আঙুল ছোঁয়াল লেজে। শক লাগল না। জোরে চাপ দিল। না, নেই। মুঠো করে চেপে ধরল। লেজ। হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। অপারেশন সাকসেসফুল!
বাইনটাকে আবার গর্তে রেখে দেয়া হলো।
আরও কয়েকটা পেইচি ধরা পড়ল সেদিন। খাবার আর পানির সমস্যা নেই। দ্বীপটা ভেঙে না গেলে এটাতে কয়েকদিন টিকে থাকতে পারবে ওরা।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মুসার অসাধারণ। দ্রুত সেরে উঠতে লাগল সে।
পরদিন দূরে একটা ক্যানূ দেখা গেল।
তার পরদিন দেখা গেল বড় বজরাকে। তীরে নোঙর করা।
দূর দিয়ে সরে যেতে লাগল ভাসমান দ্বীপ। হতাশ চোখে নৌকাটার দিকে তাকিয়ে রইল তিনজনে। ক্ষোভে, দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কুমিরের তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল মুসা, ঠেকাল কিশোর। কুমির ছাড়াও ভয়ঙ্কর পিরানহা আছে নদীতে।
ভ্যাম্পকে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বনে ঢুকেছে জানোয়ারগুলোর খাবার। জোগাড় করতে। আচ্ছা, কোনটাকে কি খাওয়াতে হয় জানে তো?~-ভাবছে। কিশোর। যত্ন নিতে পারছে ঠিকমত??
আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল বজরা।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল ওরা, ভাটির দিকে চলছে না আর দ্বীপ। পাক খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে চওড়া একটা খালের মুখের দিকে। মূল স্রোত থেকে কিভাবে যেন সরে গিয়ে ঘূর্ণিপাকে পড়েছে।
চুড়ান্ত হলো হতাশা, বড় বজরাকে ধরার আশা একেবারে শেষ। চোখের সামনে দিয়ে পাল তুলে শা শা করে পার হয়ে যাবে নৌকাটা, ওরা কিছুই করতে পারবে না। বাঁশ কেটে লগি বানানো যায়, কিন্তু লগি দিয়ে ঠেলে এক চুল নড়াতে পারবে না এত ভারি দ্বীপ।
ভাটির দিকে না গিয়ে পাশে সরে ঘূর্ণাবর্তে পড়েছে কেন দ্বীপটা, বুঝতে পারল কিশোর। বাতাস এখন উজান বইছে। দ্বীপের তুলা গাছে ধাক্কা দিচ্ছে জোরাল। বাতাস, ঠেলছে। ভাটিয়াল স্রোতের তোড় কম। বিপরীত স্রোত ঠেলে না পারছে উজানে যেতে, বাতাসের জন্যে না ভাটিতে নামতে পারছে, বেকায়দায় পড়ে পাশে সরতে বাধ্য হয়েছে দ্বীপ।
উজানে বড় বজরাকে আসতে দেখা গেল। পাল নেই। তাতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই, কারণ বাতাস বিপরীত। স্রোতে ভেসে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে নৌকাটা।
আশা জাগল আবার ছেলেদের মনে। দ্বীপের মতই বড় বজরাও যদি বিপথে সরে, ঘূর্ণাবর্তে এসে পড়ে?
ভ্যাম্পের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা মনে হতেই রাইফেলে হাত বোলাল কিশোর।
জলদি, বলল সে, গাছের আড়ালে লুকাও, সবাই।
তুলা গাছের ডালপালার আড়ালে লুকাল তিনজনে।
ডালে ঝোলানো হ্যামকগুলোর ওপর চোখ পড়ল কিশোরের। ভ্যাম্পের নজরেও পড়ে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি গিয়ে ওগুলো খুলে আনল।
সরে যাচ্ছে নৌকা। নাহ, আশা আর নেই। বিপথে পড়েনি।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মুসা, ইয়াল্লা!
ঝটকা দিয়ে নৌকার মুখ ঘুরে গেছে। মূল স্রোত থেকে সরে আসতে শুরু করল পাক খেয়ে খেয়ে। পড়েছে ঘূর্ণির টানে!
একটিমাত্র বুলেট রয়েছে রাইফেলে, মিস করতে চাইল না কিশোর। অস্ত্রটা তুলে দিল মুসার হাতে।
ভ্যাম্পকে খুঁজল তিনজোড়া চোখ। নৌকা আরও কাছে এলে দেখা গেল ডেকে শুয়ে আছে সে। নড়ছে না, নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে।
জন্তু-জানোয়ারের ডাক কানে আসছে। বোঝা যায়, ওরা ক্ষুধার্ত। নাকুর চি চি, জাগুয়ারের ভারি গোঙানি, আর ময়দার কিচির মিচিরের সঙ্গে যোগ হয়েছে। পাখিগুলোর নানারকম ডাক।
বজরার পরিচিত পরিবেশ দেখে ভাল লাগছে তিন গোয়েন্দার। মাস্তুলে ঝুলন্ত শুকনো কিকামুকেও মনে হচ্ছে যেন পরম আত্মীয়। ধ্যানমগ্ন হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে লঘু বগা, ভাল লাগছে তাকে। সুন্দর খুদে হরিণ, তাকে ভাল লাগছে। এমনকি ডাকাত অ্যানাকোণ্ডাকেও এই মুহূর্তে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে ওদের।
দ্বীপের কাছাকাছি চলে এল বড় বজরা, চারপাশে পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল, যেন গ্রহের চারপাশ প্রদক্ষিণ করছে একটা উপগ্রহ। কাছে আসছে ধীরে ধীরে। পানির গভীরতা এখানে কম, মাঝে মাঝেই ঘষা লাগছে দ্বীপের তলায়। দ্বীপ ভেঙে যাওয়ার ভয় করছে ছেলেরা।
তবে ভাঙল না। তীরে ঠেকে আটকে গেল। নৌকাটা নাক সোজা করে এসে ধাক্কা খেল দ্বীপের কিনারে, নরম মাটিতে গেঁথে গেল গলুই।
দারুণ হয়েছে! ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। এবার যাওয়া যায়, নাকি?
চলো, বলল কিশোর।
হ্যামকগুলো নিল রবিন। মুসার হাতে রাইফেল। গর্ত থেকে লেজ ধরে বাইনটাকে তুলে নিয়ে এগোল কিশোর।
নিঃশব্দে এসে নৌকায় উঠল ওরা।
অঘোরে ঘুমাচ্ছে ভ্যাম্প, কি ঘটছে খবরই নেই।